ঋ খুব আনমনে চেয়ে বৃষ্টি দেখছে । লাকড়ির চুলায় রান্না করা খিচুড়ির ঘ্রাণই অন্যরকম , সাথে কাগজি লেবুর গন্ধ । আজকের রান্না ঋ-র নিজের করার কথা ছিলো । কিন্তু এখন বৃষ্টি হচ্ছে। তাই এসব ঘরের কাজ সে আজ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে । মেয়ের এই কথা শুনে তার মা ‘’ নাবাবজাদি ‘’ বলে গালি দিতে দিতে রান্না ঘরের দিকে গেলো । ঋ মনে মনে ভাবলো, পৃথিবীর এক মাত্র মানুষ যারে কিছু না দিয়েও সবটুকু চেয়ে নেওয়া যায় – মা ।

এই ঋ আর গ্রামের সেই স্কুল-বালিকা নেই। আজ সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী । ইংরেজিতে লিখা মোটা মোটা বই পড়ে সে । তার মধ্যে একটি নিয়ে এসেছে গ্রামের বাড়িতে । সেই বই পড়ে সে তার মাকে জানালো ১০০ তলা কোন বিল্ডিঙের উপর থেকে তারে এবং তার মাকে ফেলে দেওয়া হলে তার মা আগে মাটিতে পড়বে। কারণ রহিমা বেগম তার মেয়ের চাইতে অনেক অনেক মোটা !

আজকেও সেদিনের মতন বৃষ্টি দেখছিলো ঋ । হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করলো,

– মা সাগরের মাঝে এই বৃষ্টি দেখতে কত সুন্দর লাগবে ঠিক না ? সামনে এতো বিশাল জলরাশি । তার মাঝে ফোটা ফোটা জল পড়ছে । কত সুন্দর দৃশ্য ।

– কি জানি । আমি তো সাগর দেখি নাই ।  

– আমি কামাই করা শুরু করে তোমাকে দেখতে নিয়ে যাবো মা ।

রহিমা বেগম কিছু বললেন না। শুধু হাসলেন ।

– মা আমার সব বন্ধু-বান্ধবীরা সাগর দেখতে যাচ্ছে  এই ছুটিতে। আমিও যাই ?

– দেখ, ছেলেদের সাথে ঘুরতে যাবার জন্য আমি তোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠাইনি । বিয়ে করার পর জামাই নিয়ে যাইস ।

ঋ আর কথা বাড়ায়নি। একবার না শোনবার পর বারবার অনুরোধ করার পাত্রী সে না ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকতে না চুকতেই ঋ-এর বিয়ে হলো । ছেলেটা খুব ভালো । ব্যাংকে চাকরী করে । শিক্ষিত পরিবার ।  যৌতুকের ঘোর বিরোধী । এমনকি ঋ-র বাবা যখন তাদেরকে ঘরের কিছু আসবাবপত্র কিনে দিতে চাইলো তাতেও সে আপত্তি জানালো । ঋ সেবার শখ করে বাবাকে বলেছিলো সমুদ্রে ঘুরতে যাবার টিকিট উপহার দিতে । ঐ টিকিটগুলো কিনে দিয়েছিলো আজগর সাহেব।  কিন্তু সেবারও ঋ-র সমুদ্র দেখা হয় নি।

ঋ –র জামাই হিসেবী মানুষ। অযথা খরচ তার একদমই পছন্দ নয়। তাই ঘুরতে যেতে সে রাজি হননি ।

ইতিমধ্যেই সংসার জীবনের এক বছর পার হয়েছে ঋ-র।  একটা কলেজে চাকরী করছে সে । মাঝে মাঝেই তার ইচ্ছে হয় জমানো টাকাগুলো দিয়ে ঘুরতে যেতে । কিন্তু জামাইকে ফেলে কোন স্ত্রীর একলা ঘুরতে যাওয়াকে মানুষ ঠিক চোখে দেখে না। ঋ মনে মনে ভাবে,

নারী হয়ে জন্ম নেবার এই কৃত্তিম সীমাবদ্ধতাগুলো সমাজ কত সহজেই না অগ্রাহ্য করে যায় ।

সময় পেরোয়, এরকম না পাবার আরও গল্প জমতে থাকে। শেষ না হওয়া  এই বিষণ্ণ উপন্যাসের মাঝেই ঋ-র কোল জুরে আসে কন্যা সন্তান। সে সন্তানও চোখের পলকেই বড় হয়ে যায়।

এই মেয়ের নাম রাখা হয়েছে ঋদ্ধি । ঋ এর ঋ এবং ধীমান এর ধী মিলিয়ে । সেই কন্যা সন্তানেরও মার মত বৃষ্টি দেখার নেশা । শহরের খাঁচার মতো বাড়ীগুলোর রেলিংয়ে হাত দিয়ে সে বৃষ্টি ধরার চেষ্টা করে। নিজের মেয়েকে  দেখে ঋ-র মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় তার কাটানো গ্রাম জীবনের কথা । কতটা সময় পেড়িয়ে গিয়েছে এরই মাঝে ।চলে যাওয়া সময় নিয়ে ভাবলে আমাদের মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে । ঋ-র মনও বিষণ্ণ হয়ে উঠলো। সেই বিষণ্ণ মন ঋ-র চোখের কোণে জন্ম দেয় নোনা জলের ।

ঋদ্ধি আজ বড় হয়েছে । কলেজ জীবন পেড়িয়ে পা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। সেখানে সে নিজের মতন বড় হতে শিখছে। হল জীবন তাকে অনেকটাই স্বাবলম্বী করে তুলেছে । যে মেয়ে ঘুম থেকে উঠে কখনো বিছানা গুছাতো না আজ তার হল রুম অনেক সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। বাজার করতে শিখেছে । হলে মাঝে-সাঝেই সে নিজে রান্না করে খায় ।

সেবারের গ্রীষ্ম কালীন ছুটিতে বাসায় আসলো ঋদ্ধি । এসেই জানিয়ে দিলো খিচুড়ি রান্না করতে । ছুটিতে বাড়ি এলে সে কখনই নিজ হাতে খায় না। তাকে খাইয়ে দিতে হয়। এতোদিন পর বাড়িতে ফেরা মেয়েকে খুশী মনে খাইয়ে দিচ্ছিলো ঋ আর এটা-সেটা নিয়ে গল্প করছিলো । হঠাৎই ঋদ্ধি জিজ্ঞেস করে বসলো

– মা আমি ক্লাসের সবার সাথে সমুদ্র দেখতে যাই ?

ঋ মেয়ের দিকে চেয়ে রইলো। খুব পরিচিত প্রশ্ন তার। উত্তরটাও অজানা নয় –   

– এখন না , বিয়ের পর যাবি যেখানে ইচ্ছা ।

ঋদ্ধিও চুপ করে রইলো। কিছু বলেনি।

ঋ নিজের ঘরে ফিরে এলো । মেয়েটাও তার মতই হয়েছে। খুব চাপা স্বভাবের । কোন কিছুই দ্বিতীয় বার মুখ খুলে চায় না। । ক্রমশই ঋর বুক ভার হয়ে আসছে । হয়তো মেয়েটারও তার মত সমুদ্র দেখা হবে না কখনই ।

– ইশমাম
– ১৯/০৪/২০২০

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
3
0
0
6
0
0
Ishmam Nur
Written by
Ishmam Nur
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Purba Anindita khan
Guest
Purba Anindita khan
3 years ago

আরেকটু ইন ডিটেইলস লিখলে ভালো আরো ভালো লাগত।

3
2
1
Nadim Satej
Member
3 years ago

গল্পটা অত্যন্ত সুন্দর বিষয়বস্তু সম্বলিত। সমাপ্তিতে ভেবেছিলাম মেয়ের কথা রাখবেন মা, কিন্তু তিনিও..!

আমার মনে হয় একজন গল্পকার তখনই সার্থক,যখন তিনি গল্পকে মানুষের আবেগের সাথে জুড়ে দিতে পারেন।
গল্পটা সত্যিই আমার মন ছুঁয়েছে। গল্পের শেষটা আমার মন ভেঙে দিয়েছে। এরকম “সুন্দর” আরো চাই!! আরো আরো লিখুন, মানুষের মনের বরফ গলুক আপনার লেখনীতে। শুভকামনা রইলো,ভাইয়া❤️

Mehruba Munira
Member
2 years ago

ঋ এর উচিৎ ছিল ঋদ্ধি’কে আর না আটকানো। একই চক্রে আর কতবার আবর্ত হবে মেয়েদের জীবন?

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!