ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বাজতে আরও ২৫ মিনিট বাকি আছে; সময় যেন স্থবির হয়ে আছে, এদিকে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আমি। কখন ১২টা বাজবে, কখন ওর সাথে কথা হবে। আচ্ছা, ওকে আমি ফোন কলে কী বলব? প্রথমেই যদি ভালবাসি বলি, তাহলে… সে কী কথা বলবে আমার সাথে? নাকি, ফোন রেখে দিবে? যদি এরপর আমার সাথে কথা না বলতে চায়! তখন আমার কি হবে? আমিও না মাঝে মাঝে কী যে সব ভাবী! বলে, মনের আড়ালে এক চিলতে হাসি মুখগহ্বরে ভেসে উঠে। খানিকক্ষণ বাদে, উপলব্দি করি হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়েই চলছে, দরদর করে ঘাম নির্গত হতে থেকে। নাহ্, আমি আবারও তার সাথে কল্পনায় কথা বলায় মশগুল।
আম্মা হাক ছেড়ে ডাকল, “সূচক! সূচক!” আমার সাজানো দিবাস্বপ্নের জগতে ছেদ পড়ল, অনিচ্ছাসত্ত্বেও চিৎকার করে বলি, “জি আসছি!” ওর কথা ভাবতে ভাবতে পুনরায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি; এখনো ১৫ মিনিট বাকি আছে, যাক বাচা গেছে! ভেবে, আম্মার রুমের দিকে পা বাড়াই। রুমে প্রবেশ করার পূর্বেই আম্মা বললেন, “ঔষধের বক্সটা দে তো।” কেমন করে আম্মা টের পায় আমি প্রায় রুমে এসে গেছি? ভাবতে ভাবতে ঔষধের বক্সটা এগিয়ে দিলাম। বক্সটা ধরে আম্মা বললেন, “রাতের ঔষধগুলো আলাদা করে দে। আমার চশমাটা তো ভেঙ্গে গেছে। এখন চোখে তো আর কিছুই দেখি না।” শুনে ভারী অভিমান জমে গেল মনে, এমন করে এসব কথা আর বলতে আছে? অভিমান চেপে আমি নরম সুরে বলি, “গতমাসের বেতন হয়তো কাল দিবে, কাল নতুন চশমা নিয়ে আসব নে।” আম্মা বোধয় শব্দহীন হাসি হাসছেন, তবুও অভিমান কমে নি আমার, খুব ধীরে ঔষধগুলো আলাদা করে দিলাম। আম্মা ঔষধ খেতে খেতে বললেন, “তোর পড়াশুনা কেমন চলছে?” আমি চাপাস্বরে বললাম, “চলছে ভালই।” আম্মা পানির গ্লাস আর ঔষধের বক্স আমার দিকে এগিয়ে বললেন, “এগুলো রেখে আয়। তোর সাথে কথা আছে।” পানির গ্লাস হতে নিতে নিতে ভাবছি, ১২টা তো প্রায় বেজে ই গেছে, এই অবেলায় আবার কথা? আম্মা কি না কি বলে, কে জানে! খানিকটা ভয়ে ভয়ে এসে আম্মার পাশে বসলাম। আম্মা বললেন, “তোর কি কিছু হয়েছে?” আমি কপাল কুঁচকে আম্মার দিকে তাকাই, অবাক করা এক হাসি রেখে বলি, “কিছু হয়েছে মানে?” আম্মা কিছুটা ইতস্ততও বোধ করছেন, তা দেখে তবু আমি বলছি, “কি হয়েছে? কথা বলছ না কেন?” আম্মা বললেন, “না, সারাদিন কেমন জানি হয়ে থাকিস। চুপচাপ, ঘরে বসে থাকিস। তাই ভাবলাম…” কথা শেষ হবার পূর্বেই আমি বললাম, “না, আমার আবার কি হবে! এখন কিছু ভাল লাগছে না তো, তাই…” আম্মা অভয় দিয়ে বলেন, “কোন সমস্যা হলে আমায় বলতে পারিস।” কথা শুনে কেমন জানি লাজুক ভাব চলে আসে আমার, লজ্জা ঠেলে দূরে সরিয়ে বলি, “আম্মা, তুমিও না। কি যে বলও!” বলে উঠে চলে গেলাম। দিবাস্বপ্নে আয়েশার কথা সারাদিন ভেবে ভেবে কবিতা লিখি, আবার গভীর রাতে তার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলি, এসব উদ্ভট আচরণ নিশ্চয় আম্মার দৃষ্টিগোচড় হয়েছে। কিন্তু মাকে কে বুঝাবে যে তার প্রাণপ্রিয় ছেলে জীবনে প্রথম বারের মত প্রেমে পড়েছে, সেখানে এসব ভালো লাগার-ভালোবাসার অনুভূতি তো জন্মাবেই!
ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বেজে ১০ মিনিট, দুরুদুরু বুকে আয়েশাকে ফোন দিই; রিং বাজচ্ছে আর তার সাথে আমার হৃদকম্পন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। একসময় সে ফোন কল রিসিভ করতে ই, আমি বলি, “কেমন আছ, আয়েশা?” মুঠোফোনের ওপাশ থেকে রিনরিনে ৬/৭ বছরের ছেলেমানুষী কন্ঠে জবাব এলো, “আছি ভালোই, তুমি?” হৃদয়ের মাঝে পবনের শীতল ধারার ছোঁয়া, ঠোঁটে আমার ভালোবাসার যে ঈষৎ হাসি লেগে আছে সেটা নিয়ে বলি, “ভালো।” শুনে আয়েশা শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল; আসলেই তো মুঠোফোনে কী আর অমন করে মনের গহীনের কথাগুলো স্পষ্টতর করে ভেসে উঠে? নাহলে কী আয়েশা আমার ভালোবাসার উষ্ণতাকে, হতাশায় ভেজা চাঁদর ঢেকে দেয়? তারপরও অনতিবিলম্বে কন্ঠের হাজারও উৎকণ্ঠা চেপে আমি বলি, “মন খারাপ?” মুঠোফোনের ওপাশের মহাকালের নীরবতা টের পাচ্ছি, কিছুক্ষন আগ পর্যন্তও আয়েশার নিঃশ্বাস উপলব্ধি করছিলাম, এখন তা শুনা যাচ্ছে না বিধায় এপাশ থেকে বললাম, “সবকিছু ঠিক আছে তো, নাকি? আমায় বলো?” আয়েশা এবারও কোন শব্দ করল না, নিশ্চুপ রইল; মাঝে মাঝে আয়েশার এমন হেয়ালিপনা দেখে বড্ড অভিমান চাপে ঘাড়ে! এদিকে মনের মাঝারে আমার হাজারো সংশয়ের নিদারুণ খেলা চলছে, তাতে মনের একেবারে চাঞ্চল্যতাটা উবে গেছে। ভেবেছিলাম, আজ এক সাথে উদাসীন জোছনা দেখব, তার ফাঁকে এডমুন্ড ওয়ালারের ‘গো, লাভলী রোস’ –এর আবৃতি শুনাব। কিছু সময় চুপচাপ বসে, কিছু সময় ভালোবাসার গাঢ় স্পন্দন উপলব্ধি করব! তা আর হলো কই, কেমন করে জানি সম্পূর্ণ পরিবেশটা পাল্টে গেল। নীরবতা ভেঙ্গে এক সময় আয়েশা বলল, “আজ আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কাল কথা বলি?” সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে দেখে, কি বলব বুঝে উঠতে পারছি নে। এলোমেলো স্বরে অনিশ্চিয়তার নিশ্চিত হবার জন্যে বলি, “কাল?” সে বলল, “হ্যা কাল। কেন? কাল…” কথায় ছেদ ফেলে, ব্যাথিত সুরে আমতা-আমতা করতে-করতে বলি, “আজ তো কথা বলাই হল না…” আয়েশা নির্লিপ্ত সুরে জবাব দিল, “আজ কিছু ভাল লাগছে না। এর চেয়ে বরং ঘুমিয়ে পড়ি… কেমন?” কন্ঠ-প্রদীপ আমার নিভে আসছে, সে পড়ন্ত ক্ষণিক কন্ঠালোতে বলি, “কতদিন তোমায় দেখি না!” ওপাশে আয়েশা চুপ হয়ে আছে, তার আয়েশানতা আমার পরিবেশকে ক্রমশ ভারী করে তুলছে। এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ব্যকুল কন্ঠে আবারও বলি, “তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে!” আয়েশার নিশ্চুপ রইল, এপাশ হতে আমি এক মনে বলতে থাকি। বুকের গহীনে জমে থাকা পুরনো স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে আমার অক্ষিকোটরে ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। আয়েশার চুপ করে আছে, ওপাশ হতে কেবল দীর্ঘ নিঃশ্বাসের ভারী স্পন্দন আলোড়িত হচ্ছে। নাকি, সে নয়নের কোনে বিদ্রোহ করা অশ্রুদের লুকচ্ছে, বলতে পারছি নে… তবে, জানতে যে অনেক ইচ্ছে হয় আমার! এক নাগাড়ে কথা বলতে বলতে কোন ফাঁকে বারান্দায় চলে আসি খেয়াল করি নি। সেখানে দাঁড়িয়ে উদার গগনে এক শশীর পাশে খেলে যাওয়া কিছু কৃষ্ণমেঘের ছায়া দেখছি, হুট করেই একটা সিগারেট জ্বালাতে ইচ্ছা করছে এখন। মুঠোফোনের ওপাশে আয়েশার সুর কেটেছে, সবেমাত্র সে কথা শুরু করল, সে অনেক পুরনো কথা। আচ্ছা, বহু পুরনো স্মৃতিগুলোর আলোড়ন বুকে এক আচমকা ধাক্কা লাগায় কেন, কেউ বলতে পারে? নাহ্, আর নিতে পারছি না, ওর সমস্ত কথাগুলো বুকে বিঁধছে, এবার একটা সিগারেট জ্বালাতে ই হচ্ছে।
ঝিরিঝিরি বাতাসের মাঝে সিগারেটে আগুন জ্বালানো বেশ কষ্টকর মনে হতেই, হাতের জ্বলন্ত কাঠিটা নিভে গেল; বিরক্তিকর! মনে মনে ঝেড়ে, ঠোঁটের কোনে সিগারেট চেপে আরেকটা কাটি বের করতে লাগলাম। ঈশান কোনে খানিকটা কালো মেঘের আগমনের দরুন, কালো আকাশে ঝুলে থাকা রুপালী চাঁদটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। কেমন করে জানি কিছুক্ষনের মধ্যেই উষ্ণ পরিবেশটা পাল্টে, শীতল ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করেছে। কানে ধরে রাখা মুঠোফোনের স্পীকারে আয়েশার অনর্গল বকবকানি চলছে, অথচ, খানিক্ষন আগেই সে ফোন রেখে দিতে চেয়েছিল। মনে হতেই মুখে আমার এক অবাক হাসির রেখে ভেসে উঠে, সিগারেট জ্বালিয়ে, মুখ তুলে ধোঁয়া ছাড়তে লাগি, সামনের আকাশে এক অদ্ভুদ মেঘের ঝলকানি খেলে যায়। ওপাশ থেকে হুট করেই আয়েশা বলে উঠল, “কবে আসবে?” এপাশে আমার চোখ ততক্ষনে কপালে উঠে গেছে, সেটা নিয়ে পালটা প্রশ্ন করি, “তুমি সত্যি দেখা করবে?” আয়েশা তার ঝাঝালো কন্ঠে আমায় বলে, “আগে দেখা করি নি?” কথোপকথনে খনিকের আচমকা ঝড়ো আভাস পেয়ে আমি আমতা আমতা করে বললাম, “না করেছ।” “তাহলে”, আয়েশার দৃঢ়টা বৃদ্ধি পেয়েছে বুঝতে পারছি; এদিকে দিয়ে যদিও মনে মনে আমার আহ্ললাদে আটখানা হবার দশা। বিধাতা কি এবার আমার উপর তার করুনার বর্ষণ ঘটিয়েছেন? ভেবে অবাক হচ্ছি, অথচ তার আগেও আয়েশার সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, বিধির সৃষ্ট বাঁধায় কখন বলা হয়নি, ‘ভালোবাসি’। কে জানে হয়তো তার জন্যেই এরপর যতবারই আয়েশাকে দেখা করার কথা বলেছি, অনেক কায়দা করে সে কথা এড়িয়ে যেত; কে না জানে, মেয়েরা এসব বড্ড সুন্দর করে করতে পারে।
(চলবে)
-সূচক
Send private message to author