পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে
স্যাটেলাইট আর কেবলের হাত…
ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী
আ হা হা, আ হা, আ হা হা, আ হা…
মহীনের ঘোড়াগুলির সবচেয়ে জনপ্রিয় আর বিখ্যাত গানগুলির একটা গান এই মুহুর্তে রামীমের ইয়ারফোনে বাজছে। অথচ রামীম অস্থিরচিত্তে বসে আছে। অথচ এই গান শুনবার পরও কোন মানুষ যে অস্থির অবস্থায় থাকতে পারে তা রামীমকে না দেখলে সেটা যে কারোর পক্ষেই বিশ্বাস করাটাই কষ্টকর হবে। যাদের পর্যবেক্ষন ক্ষমতা ভালো তদের কেউ যদি রামীমকে অল্পকিছুক্ষন পর্যবেক্ষন করে তাহলে সহজেই বুঝতে পারবে যে রামীম মূলত গান শোনবার জন্য নয় কেবল শুধুমাত্র কানে কোন কিছু একটা গুজে রেখে পাবলিক বাসে সময় কাটানো দরকার সেই জন্যই সে কানে ইয়ারফোন গুজে গান চালু করে দিয়েছে।
সময় সকাল ১০টা। আর যেকোন ৫-১০ টা দিনের মতোই ব্যস্ত ঢাকা নগরী। মানুষের ছোটাছুটি, রাস্তার এক লেনে বাস আর প্রাইভেট কারের কম্পিটিশন আর অন্য লেনে বিশাল লম্বা জ্যামের সমাহার। জ্যামে বসে থাকা মানুষগুলোর চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি ভর করে আছে। তারা হতাশ চোখে রাস্তার অপরপাশের গাড়িগুলার চলাচল দেখছে আর মনে মনে ট্রাফিক- সার্জেন্ট আর দেশের সিস্টেমকে অভিশাপ দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ তো আরো এক ডিগ্রী উপরে। একটু পর পর অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে। রামীম এইমুহূর্তে হতাশ হয়ে অভিশাপ দেওয়া লোকদের দলে শামিল হয়েছে। ঠিক সকাল ১০ টায় তার একটা অফিসে ইন্টারভিউ দিবার জন্য উপস্থিত থাকবার কথা ছিল। এই মুহুর্তে ১০.১৫ বাজে অথচ তার গন্ত্যবের তিন-চতুর্থাংশ পথ পাড়ি দেয়া হয়েছে। গত ২৫ মিনিট ধরে সে জ্যামে বসে আছে তার উপর মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে যোগ দিয়েছে তার পাশে বসে থাকা এক বিরক্তিকর সহযাত্রী। অনবরত ফোনে কোন এক আঞ্চলিক ভাষায় অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে কার সাথে। আর প্রতি ২-৩ মিনিট পরপর অকথ্য ভাষার গালি তো আছেই। রামীম কটমট চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না। কারনে সে এই মুহুর্তে কোন প্রকার ঝামেলা চাচ্ছে না।
চাকরীটা রামীমের অত্যন্ত প্রয়োজন। পড়াশুনা শেষ হয়েছে প্রায় ৪ বছর আগে। প্রথম এক বছর ঘুরাঘুরি করে সময় কাটিয়ে দিলেও পরের ৩ বছর সরকারি চাকরীর প্রস্তুতি আর পরীক্ষার পিছনেই সময় কেটে গিয়েছে। কিন্তু ব্যর্থতা আর দুর্ভাগ্য যেন রামীমকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এমনও দিন গিয়েছে পরীক্ষার দিন হলে উপস্থিত হয়েও সে পরীক্ষা দিতে পারে নি। এদিকে সরকারি চাকরীর বয়সও প্রায় শেষের দিকে। আজকাল সে বেসরকারী চাকরীরও চিন্তা-ভাবনা করছে। কিন্তু বেসরকারী চাকরী তো চাইলেই পাওয়া সম্ভব না। এই পর্যন্ত রামীম ১২-১৩ টা জায়গায় ভাইভা দিয়ে এসেছে কিন্তু কোন সুবিধা করতে পারে নি। প্রতিবারই তাকে বলা হয়েছে যে তার সাথে পরবর্তীতে যোগাযোগ করা হবে কিন্ত কেউই কোনপ্রকার যোগাযোগ করে নি। প্রথম ৩-৪ বার সে অনেক অপেক্ষায় থাকলেও পরবর্তীতে সে যখনই এই কথা শুনত ধরেই নিত তার এই চাকরীটা হচ্ছে না। বাসায়ও আজকাল অনেক কথা শুনতে হচ্ছে তাকে চাকরী না পাবার জন্য। শুধু বাসার লোকজন হলেও কথা ছিলো। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীও সুযোগ পেলে তাকে কথা শোনাবার পূর্ণ সদব্যবহার করছে।
এদিকে প্রাপ্তির বিয়ের জন্য অনেক চাপ দিচ্ছে রামীমকে। কিন্তু রামীম এই মুহুর্তে বিয়ে করার কোন অবস্থাতেই নেই। কিন্তু প্রাপ্তি তা শুনতে নারাজ। কয়েকদিন পর পর প্রাপ্তিকে দেখতে ছেলেপক্ষ আসছে। প্রাপ্তি কোন না কোনভাবে তাদের মানা করে দিচ্ছে। আজকের চাকরীর ইন্টারভিউটাও প্রাপ্তির ম্যানেজ করে দেওয়া। তার বন্ধুর পরিচিত কোন এক আত্মীয়ের মাধ্যমে এই ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা হুয়েছে। প্রাপ্তি কাল রাতেও তাকে ভালোভাবে স্মরন করে দিয়েছিলো যে, সে যেন কোনভাবেই দেরী না করে। এই জন্য রামীম সকাল ৮ টাতেই বাসা থেকে বের হয়ে যায় যাতে সে সময়মতো পৌঁছাতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যাকে একবার সঙ্গ দিয়া শুরু করে তাকে তো আর সহজে ছাড়তে চায় না। কোন এক ভিআইপি যাবে তার অফিসের রাস্তা দিয়ে তাই এক পাশের সব পরিবহন বন্ধ রয়েছে। এই দেশে এই ঘটনা তো আর নতুন নয়। মানুষ বাঁচুক বা মরুক এতে কারোরই কিছু যায় আসে না। বাসের ভেতরই রামীম প্রচন্ড উশখুস করতে লাগলো। এই ইন্টারভিউটা সে কোনভাবেই সে মিস করতে চায় না। চাকরী পাবে কি পাবে না তা সে জানে না। কিন্তু প্রাপ্তির জন্য হলেও তাকে ইন্টারভিউ বোর্ডে উপস্থিত থাকতে হবে। একবার সে মনে মনে ভাবলো বাস ছেড়ে রাস্তায় হাটা আরম্ভ করবে কিনা? মনে মনে সে নিজেকে তিরস্কার করতে লাগলো বাইক সার্ভিস না নেবার জন্য। সকালে একবার চিন্তা করেছিলোও বটে কিন্তু ভাড়া দেখে তার আর সাহসে কুলায় নি। কিন্তু এখন তার এই মুহুর্তে প্রচন্ড আফসোস হচ্ছে। সে মাথা নীচু করে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ধীরে ধীরে বাস ছাড়তে শুরু করছে। রামীম মনেপ্রাণে প্রার্থনা করছে আর সে যেন কোন জ্যামের সম্মুখীন না হয় বা আর কোনভাবেই যেন যানবাহন বন্ধ না করে দেওয়া হয়। উপরওয়ালা যেন অনেকদিন পর রামীমের কথা শুনলেন। বাকিটা পথে কোন ঝামেলা হল না। রামীম ঠিক ১০.৪৫ অফিস বিল্ডিং এর সামনে এসে পৌছাল। মনে মনে রামীম দেরী হবার কারণ কিভাবে ব্যাখা করবে তা গুছিয়ে নিলো। এরপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে সে অফিসের ভিতরে ঢুকে পড়লো।
পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে
স্যাটেলাইট আর কেবলের হাত…
ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী
আ হা হা, আ হা, আ হা হা, আ হা…
এই মুহুর্তে সন্ধ্যা ৬ টা বাজে। সকালের মতো এখনো রামীম জ্যামে বসে রয়েছে। রামীমের কানে আবারো এই একি গান বাজছে কিন্তু সকালের মতো সে এখন কোন অস্থিরতা নেই। অনেকদিন পর তার নিজেকে অত্যন্ত নির্ভার লাগছে। রাস্তার অপর পাশেও জ্যাম। সেখানে এক বাসে বসে থাকা এক যুবক রামীমের নজর কাড়লো। সেও কানে ইয়ারফোন গুজে অস্থিরভাবে বসে আছে। হয়তো সেও কোন তাড়ার মাঝে আছে। হয়তো সময়মতো টিউশনিতে যাবার তাড়া কিংবা প্রেমিকার সাথে দেখা করবার তাড়া কিংবা কোন মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দিবার তাড়া। তাকে দেখে রামীম মুচকি হেসে দিলো। সকালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি তার চোখের সামনে আবার ফিরে এলো। কে জানে এই ছেলেটিও হয়তো আবার যখন ঘরে ফিরবে তখন হয়তো তার চোখে-মুখে এখনের মতো কোন অস্থিরতা থাকবে না। হয়তো সে হয়তো তার মতো একি গান শুনবে কিন্তু তখনের অভিজ্ঞতা হবে এখনের চেয়ে সম্পুর্ন আলাদা।
ইন্টারভিউ এর সময়টা সকাল ১০ টার বদলে বেলা ১২ টায় নিয়ে আসা হয়েছিল কিন্তু কোন এক কারনে রামীমকে জানানো সম্ভব হয়নি। তাই রামীমকেও আর কোন দেরী হবার কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়নি। ইন্টারভিউটাও রামীমের বেশ ভালো হয়েছিলো বিধায় রামীমকে অফিস কর্তৃপক্ষ চাকরির অফার করে। বেতন টাও বেশ ভালো। রামীমও চাকরীর অফার পাবার সাথে সাথে রাজী হয়ে যায়। এর কিছু ছোটখাট ফর্মালিটিজ শেষ করে বেলা সাড়ে তিনটায় সে অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়ে। অফিস থেকে বেড়িয়েই সে প্রাপ্তির সাথে দেখা করতে চলে যায় প্রাপ্তির ক্যাম্পাসে।
ফোনের একটা ছোট্ট ভাইব্রেশনে রামীম আবারো বাস্তবতায় ফিরে এলো। কিছুক্ষনের জন্য সে যেন দুপুরের সময়টায় ফিরে গিয়েছিলো। ধীরে ধীরে আবারো জ্যাম ছাড়তে আরম্ভ করেছে। রামীমের ইয়ারফোনে সেই একি গানটা বেজে যাচ্ছে।
তার চেয়ে এসো খোলা জানালায়,
পথ ভুল করে কোন রাস্তায়,
হয়তো পেলেও পেতে পারি আরো সঙ্গী…
ভেবে দেখেছো কী,
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে,
তারো দূরে,
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে..
-Trishan
Send private message to author
বেশ অনেক দিন পর ই তো লিখেছিস মনে হচ্ছে। ভালো, চালিয়ে যা। স্বভাবতই, মূলভাবের সাথে গল্পের নামের সামাঞ্জস্যটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
পরাবাস্তবতা, নাকি রূঢ় বাস্তবতা, পুরোপুরি অনিশ্চিত! জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’ -এর “ঘোড়া” কবিতাটা পড়িস, তাহলে বুঝতে পারবি কী বলতে চাচ্ছি। Poetics by Aristotle, The Anatomy of Story are highly recommended!