চারটি সত্তা,গল্প এবং কিছুটা ভয়


কোনরকমে পড়াশোনা শেষ করে যখন হঠাৎ করে ব্যাংকের চাকরিটা পেয়ে গেছিলাম, বোধ করি সেটা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার থেকে কম ছিলো না । এর পরপরই মা চেয়েছিলেন একটা ভালো মেয়ে দেখে আমাকে বিয়ে করিয়ে দিতে। ভুলেও সে ভুল করিনি । নারী আসক্তি একসময় থাকলেও এখন মোটেও নেই । ও পাড়ায় এককালে যাওয়া-আসা করলেও এখন আর ওসব করি না । সঙ্গদোষে আমার লোহা ভাসতে ভাসতে ডুবে গেছে বলা চলে । নারী ছেড়ে এখন গাঁজা ধরেছি । চাকরিতে জয়েনের পর এই মফস্বলে যখন বদলি করা হলো, ভেবেছিলাম গাঁজা-ভাং পাওয়া যাবে না আর । মফস্বলে এগুলোর তেমন ব্যবসা হয় না জানতাম । কিন্তু এখানে এসে শুনলাম এসবের সাপ্লাই বেশ জমজমাট । এখানকার মাদক কর্তা নাকি প্রেসিডেন্ট এরশাদের আস্থাভাজন মন্ত্রীর খাস লোক । তাই দেদারসে বেঁচা-কেনা চলে । আশেপাশের জেলাগুলোর সাপ্লাই এখান থেকেই যায় শুনলাম । অফিসের পর আমার আর কোন কাজ নেই তেমন । তাই গাঁজার দমেই রাতটা পার করি । ব্যাচেলর জীবনে আমার কোন ঝামেলা নেই । কলিগদের মধ্যে যারা আমার বন্ধু তাদের নিয়ে মাঝেমধ্যে আড্ডা চলে আরামসে । সেদিন আর ছাই-পাশ গিলি না । আড্ডা দিতে দিতে অনেকসময় রাত হয়ে যায় । সেদিন আরও জমে যায় । সেরাতে কেউ বাড়ি ফিরে না । তাস পিটানো হয়, ক্যারম খেলা হয়,আষাঢ়ে গল্পও হয় । আর খাওয়া-দাওয়ার কমতি হয় না মোটেও । আজ রাতে আমার গাঁজার দম নেয়া হয়নি । আজ আমার বাসায় আড্ডা বসেছে । আমার বন্ধু মেরাজ, কলিগ অনিক ভাই আর আশিষ । সাথে আমি এই অধম । এই চারজনে মিলে আজকের আড্ডা । যত যাই হোক আজকে এখানেই থাকা হবে সবার । কোন নড়নচড়ন নেই । হঠাৎ করে অনিক ভাই খেপে উঠলো । অনিক ভাই আবার চেইন স্মোকার । দু শলাকা টেবিলে ছুড়ে দিয়ে বললেন, কি যে করো মিয়ারা! আড্ডা জমে নাকি এভাবে?
কি হইসে অনিক ভাই? জিজ্ঞেস করলাম ।
রাতের আকাশটা মেঘলা । বৃষ্টি হবে হবে । বুঝোস না?
আশিষ চোখ সরু করে টিপ্পনি কাটলো, এই জন্যই বলি বিয়েশাদি করা ফরজ কাজ ।
অনিক ভাই আশিষের কথা গায়ে না মেখে বললেন, খিচুড়ির ব্যবস্থা করে ফেল । ৪টা ডিম ভাজ ।
আমি সায় দিয়ে খিচুড়ির বন্দোবস্ত করতে উঠতে যাবো এমন সময় প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । সাথে দমকা হাওয়া হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকতে শুরু করলো । মেরাজ এতক্ষণ জানালার পাশে বসে ছিলো । হঠাৎ বৃষ্টির ছিটায় একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা । খিস্তি দিতে দিতে উঠে গেল সে । কারেন্ট যে আজ আসবে না বোঝা যায় । বাসায় খান দশেক মোম এনে রেখেছিলাম বলে যা রক্ষে । একটা মোম স্ট্যান্ডে রাখলাম । আশিষ বললো তখন, কি করবি? এভাবে চুপ করে থাকবো?
মেরাজ বললো, আগে খাওয়ার ব্যবস্থা হোক তারপর যা করার করা যাবেনে ।
এক কাজ করা যায় । উপরে চিলেকোঠা আছে । সেখানে গিয়ে বসা যায় । রান্নার মালসামান,হাঁড়ি-বাসন আর স্টোভ নিয়ে বসা যায় । সেখানেই রাতে সব মিলে থাকা যায় । এই প্রস্তাব দিতেই সবাই লুফে নিলো । একটু পরেই বোঝা কোলে উপরে গেলাম । কার্ড আমার পকেটেই ছিলো । রান্না বসিয়ে দিয়ে টুয়েন্টি নাইন খেলতে বসে গেলাম । কিছুক্ষণ খেলার পর অনিক ভাই বঁেকে বসলো । নাহ! এই *লের আধা অন্ধকারে খেলা যায় নাকি?তাইলে কি করবেন ভাই? আমি জিজ্ঞেস করলাম ।
আলাদা কিছু কর!
আশিষ বললো, চলেন বাজি ধরে কার্ড খেলি ।
এবার মেরাজ বললো, নিজেদের জীবনে ঘটা অদ্ভুদ ঘটনা শেয়ার করা যেতে পারে ।

মেরাজের কথাটা আমাদের মনে ধরলো । পরিবেশটাও মানানসই । অন্ধকার চারদিকে । ঝড়বৃষ্টি স্নাত আবহাওয়া । ঠিক হলো যে অদ্ভুদ,ভৌতিক কিংবা অতিপ্রাকৃত গল্পই বলা হবে এক এক করে । তাই সই । খাওয়া-দাওয়া শেষ । সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে গল্প বলা শুরু হলো । কেউ গল্পের মাঝখান দিয়ে বেশি প্রশ্ন করবি না, অনিক ভাই সাবধান করে দিলেন সবাইকে। অনিক ভাই এগিয়ে এলো প্রথমে বলার জন্য । আশিষ আবার আবহ তৈরি করার জন্য মোম বন্ধ করে দিলো ।

হাকিনীর নাম শুনেছ কখনো? অনিক ভাই এর প্রশ্ন শুরুতেই ।
আমাদের সবার উত্তর একটাই, না । এটা কি জিনিস ভাই? মেরাজ জিজ্ঞেস করলো । অনিক ভাই একটা তৃপ্তির হাসি দিলো । এখন আস্তে আস্তে করে গল্প বলবে আর আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিবে ।
হাকিনী হল পিশাচ । এরা হল নিম্নস্তরের পিশাচ ।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, পিশাচ? হুহ! গাঁজাখুরি জিনিস সব ।
আশিষ আমাকে ধমকে দিয়ে বলল, জানিস না বলে যা ইচ্ছা তাই বলবি? চুপচাপ শুনে যা । ভাই আপনি বলেন ।
আমাদের বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু করেন বখতিয়ার খিলজি । প্রচণ্ড শক্তিশালী রাজা লক্ষন সেন কে মাত্র ১৭ জন সৈন্য নিয়ে তার রাজত্ব ধূলিসাৎ করে দেন এই বখতিয়ার । নদিয়া থেকে দূরে বিক্রমপুর এ যান লক্ষন সেন । যে করেই হোক তিনি রাজ্য ফিরে পেতে চান । কিন্তু লোকবল কিংবা শক্তি দুটোই কম ছিল তার । তাই তিনি ঝুঁকলেন মন্ত্র- তন্ত্র এর দিকে । লক্ষন সেন এর সাথে ছিলেন লক্ষি নারায়ণ , তার মন্ত্র সাধনার গুরু । দুজনে মিলে ঠিক করলেন হাকিনী নামের এক পিশাচ কে ডাকবেন । এই পিশাচ কে ডাকতে শবসাধনা করতে হয় ।
মেরাজ থামিয়ে দিয়ে বললো, এটা কি ওই প্রক্রিয়া যে মৃতদেহ এর সাথে যৌন ক্রিয়া করে যে সাধনা করা হয়?
অনিক ভাই বললেন যে, এটা ঠিক আমি জানি না। হতে পারে সেইরকম বা তার কাছাকাছি । তো সেই হাকিনী নিম্ন স্তরের পিশাচ হলেও এর ক্ষমতা কম ছিল না । সাধনা করে ডেকে এনে তাকে দিয়ে যে কাউকে খুন করানো যেত । কেউ বুঝত না কে মেরেছে। তবে তাকে চিনিয়ে দিতে হবে। রাস্তা না দেখিয়ে দিলে সে কাউকে চিনতে পারে না । ঠিক করা হল হাকিনী দিয়ে বখতিয়ার কে মেরে ফেলা হবে । কিন্তু হাকিনী ডেকে এনে তাকে বখতিয়ার এর কাছে নিয়ে যেতে হবে । হাকিনী থাকে চির অন্ধকার দেশ এ । তাকে ডেকে আনার সব জোগাড় শুরু হল। বাসমতি চাল পুড়িয়ে বানানো কয়লার সাথে ঘোড়ার রক্ত আর আর গর্ভবতী নারীর প্রসাব মিশিয়ে কালি তৈরি করা হল । সেই কালি দিয়ে সিল্কের কাপড়ে হাকিনী জাগানর মন্ত্র লেখা হল । দুটো বালার ভিতরে সেই কাপর ঢুকিয়ে দিয়ে দুজন লোক দিয়ে সেই বালা পাঠানো হল বখতিয়ার এর কাছে । উদ্দেশ্য বখতিয়ার এর কাছে সেই বালা পৌঁছানো । হাকিনী জাগবে এবং বখতিয়ার কে চিনে নিয়ে বধ করবে বখতিয়ার খিলজি কে । কিন্তু খোদার রহমত আর বখতিয়ার এর প্রিয়া দময়ন্তী এর প্রার্থনায় বখতিয়ার এর কিছু হয়নি। একটুর জন্য বাংলার ইতিহাস বদলে যায়নি । বখতিয়ার তখন রংপুর এ । লক্ষন সেন এর দুই লোক সেই বালা নিয়ে পৌছাতে পারেন নি । পদ্মা পার হয়ে বরেন্দ্র কিংবা রাজশাহীর এক গ্রাম এ এসে তারা মারা পরেন । নিয়তি তাদের রংপুর এ পৌছাতে দেয়নি , আর হাকিনীও জেগে উঠতে পারেনি ।

অনিক ভাই এবার থামলেন । শ্বাসরুদ্ধকর এক গল্প শুনালেন । বখতিয়ার এর সাথেও এসব করা হয়েছিল আমরা কেউ জানতাম না । আমি ফিসফিসিয়ে বললাম, কি শুনালেন ভাই? আপনি প্রথম গল্পেই হিট ।
অনিক ভাই হেসে বললেন, কত কিছু জানিস না তোরা । আমার ঝুলি তে এরকম জিনিস কম নেই একেবারে । আশিষ অনুরোধ করলো, ভাই আরেকটা শুনান না…
অনিক ভাই বললেন, না থাক । এবার অন্য কেউ বল । মেরাজ বল এবার ।
মেরাজ গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলো।
আমার এটা কোন ভৌতিক গল্প না , আমার এটা কোন আগে শুনো এরপর বইলো ।ভিতরে রহস্য আছে ।

আমি যখন ভার্সিটিতে পড়তাম তখন হলেই থাকতাম । গ্রামে বেশি যাওয়া হতো না । মাঝে মধ্যে ছুটি পেলে যেতাম । আম্মা তখন বাড়িতেই থাকতো ।কয়েকদিন থেকে আবার ভার্সিটিতে চলে আসতাম । তো সেবার গ্রামে গিয়েছিলাম প্রায় আট-নয় মাস পরে ।গিয়ে দেখি গ্রামে নতুন করে একটা হাইস্কুল বানানো হয়েছে । সবার জন্যই ভালো এটা । আগে শুধু প্রাইমারি স্কুল ছিল গ্রামে ।অন্য গ্রাম এ এখন যাওয়া লাগবে না পড়ার জন্য। এত কিছুর মাঝেও গ্রামে যাওয়ার পর শুনলাম গ্রামের অবস্থা বেশি ভালো না ।সেই স্কুলের গণিতের শিক্ষক ছিলেন আবিদ স্যার । খুব ভালো গণিত পড়াতেন
। উনি বিভিন্ন বাড়িতে ছাত্রদের প্রাইভেট পড়াতেন । সমস্যা তখনই দেখা দিলো যখন উনার একে একে ২জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করলো । পুলিশ আসলো , তদন্ত করলো । লাশ নিয়ে গেলো । কোন ক্লু পেল না ।তাই আত্মহত্যার কারণও জানা গেল না । আস্তে আস্তে গ্রামের মানুষের আগ্রহ কমে গেলো । সব স্বাভাবিকই ছিলো । কিন্তু… কিন্তু আবারো আরেকজন আত্মহত্যা করলো ।পুলিশের নজর পড়লো এবার আবিদ স্যারের উপর । ৩জন ছাত্রই উনার কাছে পড়তো । তবে এটা কোন জোরালো সন্দেহ না । প্রায় সবাই তার কাছে পড়তো । তবে গ্রামবাসীর মনে ভয় ঢুকে গেল । তারা ভেবে নিলো যে আবিদ স্যারের সাথে কোন শয়তান বা জ্বীন আছে । তার ছাত্র পড়ানো শিকেয় উঠলো । গ্রামের লোকেরা পারলে তাকে পিটিয়ে মারে । ছাত্রদের স্কুলে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । আবিদ স্যারের কেউ ছিল না । তাই তিনি ভাবলেন চলে যাবেন এখান থেকে । এবং তিনি একদিন চলে গেলেন গোপনে । লোকটা যে রাতে চলে গেলেন,সে রাতেই আরেকজন অর্থ্যাৎ ৫ম জন আত্মহত্যা করলো । লোকজন তার বাড়িতে ছুটলো কিন্তু ততক্ষণে উনি পগারপার । আমার তখন প্রচন্ড আগ্রহ ।স্কুল থেকে উনার সম্পর্কে তথ্য নিলাম । দুই বন্ধুকে সাথে নিয়ে ছুটলাম উনি আগে যে এলাকায় ছিলেন । সেখানে গিয়ে জানলাম ওখানেও একই অবস্থা ছিল। যা ভেবেছিলাম তাই ঠিক । উনার সাথে অবশ্যই আত্মহত্যার কোন যোগসূত্র আছে । কিন্তু কোথায় এবং কীভাবে সেটা পুলিশ বের করতে পারেনি । এরপর আবিদ স্যার একপ্রকার রহস্য হয়েই হারিয়ে যান ।

এরপর কি হইলো? অনিক ভাই এর প্রশ্ন।
এরপর কিছুই হয় নায়।
কিছু হয় নায় মানে? খুজে পাস নাই আর?
নাহ। তবে এরপর আমি আমাদের ভার্সিটি এর সাইকোলজিকাল স্যার এর সাথে এগুলা শেয়ার করি । উনি এই ঘটনার পক্ষে যুক্তি দাঁড়া করিয়ে দেন । উনি বলেন যে , আবিদ স্যার ছিলেন মানসিক ভাবে অসুস্থ । উনি উনার ছাত্রদের মধ্য থেকে কাউকে টার্গেট করতেন । যাকে টার্গেট করতেন সে হত ভিকটিম। আর এই সময় উনি হতেন ম্যানিপুলেটর । উনি ছাত্রদের আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে দিতেন । ছাত্ররা আত্মহত্যা করলে উনি তৃপ্তি বা আনন্দ পেতেন । উনি ভিকটিম এর উপর ব্রেকিং ডাউন দ্যা টার্গেট ধাপ দিয়ে শুরু করতেন । উনি ভিকটিম কে আস্তে আস্তে কথা দিয়ে প্রভাবিত করতেন । ভিক টিম এর মধ্যে কোন কারনে হতাশার জন্ম দিতেন । সে কোন জিনিস পাচ্ছে না, তার কোন সমস্যা, কিংবা তার পরিবারে ঝামেলা এগুলা দিয়ে তিনি তাদের মনে হতাশা বাড়াতেন, তাদের বুঝাতেন যে তোমার আর বেঁচে থাকার কোন উদ্দেশ্য নেই। জীবন সম্পর্কে তিক্ততা বাড়িয়ে দিতেন উনি । শেষ ধাপে উনি বুঝাতেন মৃত্যু যাবতীয় হতাশার শেষ । মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই তিক্ত জীবন থেকে সরে যাওয়া সম্ভব । এভাবেই উনি উনার ছাত্রদের আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে নিতেন। এটা সবার পারতেন না। খুব অল্প সুযোগ পেতেন তিনি, তাই তার ভিকটিম ও কম ছিল ।

আশিষ বললো, ভালো গল্প ছিল তো! এটা তো এক প্রকার ব্রেইন ওয়াশ ।
হ্যাঁ, এটাই ব্রেইন ওয়াশ ছিল । ওই হারামজাদাকে মেরে ফেললে ভালো হতো । সে রাতেই ও পালিয়ে যায় ।
মর্মান্তিক আসলেই , মন্তব্য করলো অনিক ভাই । এবার কে বলবি গল্প?
আমি বলি এবার, আশিষ বললো ।
অনিক ভাই তো এক পিশাচ এর গল্প শুনাল । আমিও এক পিশাচ এর গল্প শুনাব । এই পিশাচ আমার নিজের দেখার, আমার নিজের অভিজ্ঞতার ……

আমার জন্ম সুন্দরবনের ওইদিকের এক গ্রামে । কিন্তু বাংলাদেশের নয়, ভারতের গ্রাম এ । আমাদের গ্রাম টা সব দিক থেকেই ঠিকঠাক ছিল । শান্তিতেই থেকেছি সবসময় । মাঝে মাঝে যেতাম বড় কাকার বাড়িতে । সেখানে আমার কাকাতো ভাই আর বোন ছিল । সারাদিন খেলাধুলা করতাম আর বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম । কাকা গ্রামের মাথা হওয়ায় আমাদের কেউ কিছু বলতো না । ঘুরে ঘুরে একেকজনের গাছ থেকে ফল পেড়ে খেতাম । মাছ ধরতাম পুকুরে । বিকেল বেলা উঠানে সবাই মিলে খেলতাম । তবে যাই করি না কেন, কাকার কড়া আদেশ ছিল সন্ধ্যাহ্নিক এর সময় যেন আমরা সবাই উপস্থিত থাকি। থাকতে হত । ভয় থাকতো সবার । সেই ভয় অন্যকিছুর । সে ভয় উখিনীর।
আমার কাকা তাই আমাদের তাই সন্ধ্যার পর বাইরে থাকতে দিতেন না । উখিনী হল সেই পিশাচ যার কথা বলবো ।

এ কেমন জিনিস যে এত ভয়? মেরাজ বললো ।

এটা অনিক ভাইয়ের হাকিনীর মতো নয় । হাকিনীর হাত থেকে বাঁচা সম্ভব হলেও উখিনীর খপ্পরে পড়লে কেউ বেঁচে ফিরতে পারেনা । উখিনীরা তাদের এলাকা নির্দিষ্ট করে নেয়; এরপর কোন জীবিত প্রাণি যদি ওদের সীমানায় আসে, বিধাতার দেয়া প্রাণ ওখানেই রেখে আসতে হয় ।
এত ভয়ংকর এরা? অনিক ভাই এবার প্রশ্ন করলেন ।

হ্যাঁ,এরা ভয়ংকর । তবে এরা অনেক ল্যাদখোর । চলাফেরার গতি কম ।

এরা দেখতে কেমন? আমার প্রশ্ন ।

এরা অনেকটা গাছের মতো।

ধূর! গাছ কখনো পিশাচ হয় নাকি? অনিক ভাই খেঁকিয়ে উঠলো ।

হয় হয় । বলা হয় যে উখিনীরা একসময় গাছই ছিলো । ওদের নিয়ে মিথও আছে । উখিনীরা একসময় সম্পূর্ণ গাছ থাকলেও এখন পিশাচ হয়ে আছে ।উখিনীদের আদি নিবাস প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে । কথিত আছে ওখানকার আদিবাসীদের দেবতা একবার কোন এক কারণে আদিবাসীদের উপর নাখোশ হন ।এরপর দেবতা তাদের দ্বীপ এর কিছু গাছ কে পিশাচ এ পরিণত করে দেন। তারা হল উখিনী। উখিনীরা তখন সেই দ্বীপ এর মানুষ দের খেয়ে ফেলতে শুরু করে । আস্তে আস্তে পিশাচ গুলো নিজেদের টিকিয়ে রাখতে অন্য দ্বীপ গুলতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে । মানুষ তখন অনেক খানি বনাঞ্চল পুড়িয়ে দিতে শুরু করে। উখিনী মরে গেলেও অনেক উখিনী সাগর পারি দিয়ে অনেক অঞ্চল এ ছড়িয়ে পরে। এর মধ্যে কিছু উখিনী আমাদের এই বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সুন্দরবনের পাশের অনেক গ্রাম এ এসে পরে। উখিনী দের বৈশিষ্ট্য হল এরা দিনের বেলা গাছের আড়ালে মিশে থাকে । রাত হলেই এরা খাবারের জন্য বেরিয়ে পরে। তবে উখিনী রা শুধু প্রাণী খায় না। এরা গরু ছাগলের গোবর খায় । তাই এরা মাঝে মাঝে রাত এ গোয়াল ঘর এ হানা দিতো ।
ছি ছি কি বলোস? মেরাজ বললো ।
ঠিকই বলসি । আমাদের গ্রাম এ এরা ছিল না। তবে বললাম না? কাকাদের গ্রাম এ উখিনী ছিল । এই নিয়ে একটা ভয়ংকর ঘটনা আছে । আমার আজ ভয় লাগে সে কথা মনে পড়লে ।আমি তখন ১২ কি ১৩ বছরের ছেলে। আমাদের সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা নিষেধ ছিল আগেই বলেছি । কিন্তু সেদিন আমাদের কাকার গ্রাম এ একটা মেলা ছিল । আমাদের জঙ্গল থেকে কিছুটা দূরে এই মেলা । সন্ধ্যার আগে আগে মেলা শেষ হয়ে গিয়েছিলো । ভয় একটাই, সন্ধ্যা নাম্লেই উখিনী হামলে পরবে । এই ভয়ে সবাই চলে যাচ্ছিলো বাড়িতে । আমি, আমার কাকাতো ভাই আর কাকাতো বোন সেদিন মেলায় গিয়েছিলাম । সবাই সমবয়েসি আমরা । কাকাতো ভাই আমার থেকে বড় ছিল, নাম বিপ্লব । সেই বিপ্লব , আমি, আর কাকাতো বোন নীলিমা যখন মেলা থেকে বাড়ি ফিরছিলাম তখন সন্ধ্যা হতে খুব বেশি দেরি নেই । আমরা যাচ্ছিলাম জঙ্গল এর পাশ দিয়ে । পাশেই মৃত্যুকূপ, উখিনীদের জঙ্গল । তাই তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছিলাম । হঠাৎ বিপ্লব বললো, তোরা যা । আমি আসতেসি ।
নীলিমা বললো, কই যাবি দাদা?
কোথাও না । তোরা যা ।
বাবা যে বকবে
বলিস যে আমি নরেন এর বাড়িতে গিয়েছি ।
কোথায় যাবা এটা তো বলে যাও
এই আশিষ ওকে নিয়ে যা তো।
আমরা বিপ্লব কে ছেড়ে চলে এলাম । আমি জানি ও কি করবে । ওর পকেট এ গুলতি। মেলা থেকে কিনেছে দেখেছি। পাখি মারবে এখন তবেই ওর শান্তি ।আমি বাঁধা দেইনি। আমরা চলে এলাম । কাকাকে আসল কথা বলিনি চেপে গিয়েছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে গেলেও বিপ্লব বাড়ি ফেরেনি ।ভয়ের বিষয় । সপ্তাহ দুই আগেও দু’জন হারিয়ে গিয়েছিলো । তারা যে উখিনীদের শিকার হয়নি তা জোর দিয়ে বলা যায় না । গত মাসেও নরেনদের দুটো গরুকে রাতে হানা দিয়ে মেরে ফেলেছিলো । কাকা তাই বসে থাকতে পারলেন না । জন আষ্টেক লোক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বিপ্লবকে খুঁজতে । ছেলে ফিরছে না দেখে অন্দরমহলে কান্না পড়ে গেছে । কাকাদের সাথে আরও কিছু লোক জড়ো হলো । প্রথমে নরেনদের বাড়িতে গিয়ে জানলো বিপ্লব এখানে আসেনি । কাকার এবার মাথা খারাপ হবার জোগাড় । ছেলে তার অতি আদরের । যে করেই হোক তাকে খুঁজে বের করতে হবে । আমি ভিড়ের মধ্যে থেকে আস্তে বের হয়ে গেলাম । প্রচন্ড ভয় লাগলেও এক গাদা সাহস জড়ো করে গেলাম জঙ্গলের ঐদিকে । পুরোপুরি জঙ্গলের ভিতর না ঢুকে আমি খুঁজতে লাগলাম । ভরা পূর্ণিমার আলো । সেই পূর্ণিমার আলোয় মিনিট দশেক পর যা খুঁজছিলাম তা পেয়ে গেলাম । আমার থেকে অনেকখানি দূরে বিপ্লব দাঁড়ানো । হ্যাঁ,বিপ্লব । তবে সে একা না । তাকে ঘিরে আছে আমাদের সেই ভয় ; কতগুলো উখিনী । মোহগ্রস্থ বিপ্লবের দিকে শ্লথ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা । কিছুই করার ছিল না,আমার কিছুই করার ছিল না । আমি দূর থেকে চেয়ে শুধু তার অন্তিম মূহুর্ত দেখেছি ।বোধজ্ঞানশূণ্য অবস্থায় দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির কাছাকাছি এসে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম । আমার কথামতো লোকগুলো সেখানে গিয়ে কিছুই পায় নি । আমি আর কখনো সে বাড়িতে যাইনি । সে স্মৃতি অনেকদিন আমাকে ঘুমাতে দেয়নি ।আশিষের গল্প শুনে কেমন যেন লাগলো । বিপ্লবের জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমাদের ।
এবার আমার পালা । নড়েচড়ে বসলাম আমি ।আমাকে দিয়ে যেহেতু শেষ,তাই আসর জমিয়ে শেষ করতে হবে । নিজে গ্লাসে পানি ঢেলে এক গ্লাস পানি ঢক ঢক করে খেয়ে নিলাম । ডান হাতের তালু দিয়ে মুখটা মুছলাম ।
জোরে শ্বাস নিয়ে একবার অনিক ভাইয়ের দিকে তাকালাম ।

আমার গল্প পিশাচের নয়, কোন রহস্যেরও নয় । আমার গল্প প্রেমের,আমার গল্প এক মৃত্যুর । বাবাছাড়া এক পরিবারের বড় মেয়েটা মায়ের কোল ছেড়ে পাড়ি জমায় শহরে । উদ্দেশ্য পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি করা । চাকরি করলে হয়তো সংসারের কষ্ট কিছুটা লাঘব হতো । সে জন্যই মেয়েটার শহরে যাওয়া । সেখানে পরিচয় এক ছেলের সাথে । ছেলেটা বেশ মিশুক । মেয়েটার সাথে অল্পতেই মিশে গিয়ে পাগল করে ফেলে । মেয়ে আস্তে আস্তে আসক্ত হয়ে যায় তাতে । গ্রামে থাকা নিজের পরিবারের কথা ভুলে যায় সে । প্রেমের জোয়ারে পরিবার ভেসে যায় তার কাছে । মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় নিজে সংসার পাতবে ভালোবাসার মানুষের সাথে । প্রস্তাবটা অবশ্য ছেলেটাই দিয়েছিলো । বিয়ে করতে দ্বিধাবোধ করেনি । নতুন নতুন চাকরি তখন ছেলেটার । মেয়েটা চেয়েছিলো সুখের একটা সংসার সাজাতে । মেয়েটার স্বপ্নও যেন সত্যি হচ্ছিল । ছেলেটা তাকে বেশি বেশি সময় দেয়, আগলে আগলে রাখে । মাথায় বেলিফুল গুঁজে দেয় । মেয়েটার বেশ ভালোই লাগে ।কিন্তু একসময় ছেলেটার এইসব আদিখ্যেতা লাগতে শুরু করে । এখন আর তার মেয়েটাকে ভালো লাগে না । ভালো লাগবে কীভাবে? এখন তো আর মেয়েটার শরীর তার অচেনা নয় । শরীরের ঐশ্বর্য সে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে । ওই শরীর তার কাছে পুরনো হয়ে গেছে । তার দরকার নতুন মেয়ে । তার আগে দরকার এই মেয়েটাকে ছাড়ানো ।একেবারে মেরে ফেলা সম্ভব নয় । কোনভাবে তাকে কৌশলে ছাড়াতে হবে । এরপর শুরু হয় অতিমাত্রার বুদ্ধির খেলা । গ্রামের মেয়ে; জ্বীন-ভূতে বিশ্বাস করে । তাই তাকে জ্বীনের ভয় দেখানো হলো । বাসার কাজের লোকটিকে সাথে নিয়ে যত রকম ভয় দেখানো সম্ভব দেখানো হয় । মেয়েটা ভয়ে কাঁদতো; রাতে ভয়ে ছেলেটার বুকে মাথা দিয়ে ঘুমাতো । ছেলেটার একটা বিশেষ গুণ ছিলো । সে ভেনট্রোলিকুইজম জানতো । ভেনট্রোলিকুইজম হলো কথা বলার এক বিশেষ পদ্ধতি যেখানে কথকের মুখ নড়বে না কিন্তু শব্দ বের হবে আর শব্দের উৎপত্তি ধরা যায় না । শেষ দিকে এসে মেয়েটিকে মাঝরাতে এভাবে ভয় দেখাতো ।মাঝরাতে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে ভিন্ন কন্ঠের কথা প্রবল আতঙ্কিত করতো । মেয়েটির আগে থেকে থ্যালাসেমিয়া ছিলো । রোগ আর ভয় মিলে সে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে । শয্যাশায়ী হওয়ার পর দুনিয়া ছাড়তে মেয়েটি দেরি করেনি ।গ্রাম ছেড়ে যাওয়া মেয়েটি আর কখনো ফিরে আসতে পারেনি ।
আমার গল্প শেষ হল । সবার চোখ আমার দিকে তাকিয়ে । আর আমি সামনে তাকানো; অনিক ভাই এর দিকে।
অনিক ভাই, কিছু মনে পরে?
অনিক ভাই এর মাথা নামানো । আমি কথা বলতে পারতেসি না, আমার গলা আটকে যাচ্ছে । আমি তারপরেও বললাম , অনিক ভাই……… মেয়েটা তো আপনার স্ত্রী ছিল তাই না?
আশিষ আর মেরাজ আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকানো । ওদের চোখ যেন বলছে কি বলস এসব? আমি আবারো বললাম, কখনও কি জানতেন মেয়েটার পরিবারের কথা? তার পরিবার এ কে কে ছিল কখন জানতেন? না জানতেন না । আপনি জানতেন না তার একটা ছোট ভাই ছিল । সেই ভাই অপেক্ষা করত তার বুবু কবে আসবে । বোন ছাড়া যে ভাই টা থাকতে পারতো না । আপনি জানবেন কিভাবে? আপনি তো শরীর হাতড়ে বেরিয়েছেন । আপনার জন্য আমার মা এর কোল খালি হয়েছে। আপনার জন্য আমি আমার বুবুকে হারিয়েছি । জানেন অনিক ভাই? আমি আপনার সেই স্ত্রীর ছোট ভাই ।
অনিক ভাই অবিশ্বাস এর দৃষ্টি দিয়ে তাকানো । তার বিশ্বাস হচ্ছে না যেন কিছুই । আমি বললাম , আপনাকে খুজেছি আমি । বড্ড দেরিতে পেয়েছি জানেন ? তবুও তো পেয়েছি ।অনিক ভাই কেঁদে দিলেন । আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মাফ করো আমায় । আমি ওকে শুধু বের করে দিতে চেয়েছিলাম তো । ও আমাকে ছাড়তে চাইতো না। আমি আর কিছু জানি নাআমি আর কথা বাড়াতে চাই না। কিছু শাস্তি নিজেদের দিতে হয় । খাটের তলা থেকে একটা ছুরি বের করে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম । মাফ নেই, কোন কিছুর মাফ নেই । জানি আশিষ কিংবা মেরাজ কেউ বাঁধা দিবে না । অনিক ভাই এর সামনে শেষবারের মতো দাঁড়িয়ে বললাম, মৃত্যু অনেক শান্তির অনিক ভাই। অনেক শান্তির। পরম শান্তির।

লেখকঃ ওমর ফারুক রাউল ( Omore Faruk Raul )

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
0
1
0
0
0
0
Omore Faruk Raul
Written by
Omore Faruk Raul
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!