বাঁধন আর ঝুমুরের অপেক্ষা।

বাঁধন আর ঝুমুরের মনটা বেশ ফুরফুরে গত কয়েক দিন থেকে। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই মাকে জিজ্ঞেস করে মা আর কতদিন বাকি? আজ কি বার? রবিবার হতে আর কতদিন?

বেশ কিছুদিন থেকেই মা আর বাবা প্রায় প্রতিদিনই আলাপ করে সামনের এক রবিবার তাঁদের কলেজের সতীর্থদের বাৎসরিক পিকনিক নিয়ে। কত পরিকল্পনা, মনে মনে কত ভাবনা তাদের এই সতীর্থ সমাবেশ নিয়ে। কতদিন পর আবার দেখা হবে কলেজের প্রাক্তন, নবীন আর সমসাময়িক বন্ধু বান্ধবীদের সাথে। কলেজ জীবনের কত আলাপন, কত স্মৃতি, কত কত ছোট খাটো খন্ড খন্ড স্মৃতিকথা মনে আসছে আজ। সারাদিন জুড়ে সেগুলোই শুনবে আর শুনাবে সবাইকে। মনে মনে ভাবে আচমকাই হয়তো দেখা হয়ে যাবে প্রায় তিন যুগ পর সতীর্থ কোন বন্ধু বান্ধবীর সাথে। ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে সাথে বাবা মায়ের অপেক্ষা ও যেন আর শেষ হতে চায় না।

রবীন আর মিতু চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রী। বছর সাতেক আগে বাংলাদেশ থেকে পাড়ি দেয় কানাডায়। থিতু হয়েছে কানাডার টরেন্টো শহরে। কানাডার এই শহরে চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীদের একটি সংগঠন আছে রবীন আর মিতু তা জানতো না।

প্রতিবেশী ঝুমা ভাবি একদিন ফোন করে মিতুকে জানায় চট্টগ্রাম কলেজের সতীর্থদের এই মিলন মেলার আয়োজনের খবর। এটা জেনে উল্লসিত হয়ে পড়ে দুজন। আর প্রহর গুণতে থাকে কখন আসবে সেই ক্ষণ যে দিন প্রাণ খুলে আড্ডা হবে প্রিয় প্রতিষ্ঠানের শত শত সতীর্থদের সাথে।

মিতুর মা কানাডায় মেয়েকে দেখতে এসে করোনা জটিলতায় এখনো দেশে ফিরতে পারেনি। মিতু সিদ্ধান্ত নেয় নিজেদের সাথে এই সতীর্থ মিলন মেলায় মাকে আর দুই বাচ্চাকে ও নিয়ে যাবে।

বাঁধন আর ঝুমুর এখনো অনেক ছোট। বাঁধন সবেমাত্র স্কুল শুরু করেছে, পড়ছে সিনিয়র কিন্ডারগার্টেনে আর ঝুমুর দ্বিতীয় গ্রেডের ছাত্রী। বাবা মা তাদের বলেছে পিকনিকে দেখা হবে অনেক আঙ্কেল, আন্টির সাথে, আরো হয়তো‌ দেখা হয়ে যাবে কোন কোন নানু, দাদু, দাদা ভাইয়ের সাথে ও। সবাই তোমাদের দুজনকে কাছে ডাকবে, কথা বলবে, আদর করবে। খুবই আনন্দে কাটবে তোমাদের সারাটা দিন। এটি শুনে খুবই উচ্ছ্বসিত দুই ভাই বোন। কল্পনায় ভেসে ভেসে দুজনেই মনে মনে আঁকতে থাকে সে দিনের একটি ছবি।

আজ রবিবার। সকাল। দিনের আলো ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে।গত রাতে ঘুমোতে যাবার আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পরের দিন পিকনিক নিয়ে কত শত রাজ্যের আলাপ দুই ভাই বোনের। সকাল নয়টা নাগাদ বেরিয়ে পড়ে রবীন আর মিতু। সাথে বাঁধন, ঝুমুর আর মিতুর মা। এক মুহূর্ত দেরী করা ঠিক হবে না। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা কখন দেখা হবে কিশোর বয়সের বন্ধু বান্ধবীদের সাথে। কখন জমে উঠবে আড্ডা। অপেক্ষার তর সইছে না আর কারো।

পার্কের সবুজ চত্বরে চারিদিকে গাছ গাছালি দিয়ে ঘেরা পিকনিক স্পটে যখন রবীন আর মিতু এসে পৌঁছায় তখন সকাল প্রায় দশটা। ইতিমধ্যে এসে গেছে বেশ কিছু প্রাক্তন শিক্ষার্থী। সবার হাতে সকালের নাস্তার প্লেট। সবুজ চত্বরে হেঁটে হেঁটে অথবা কোথাও ছোট ছোট দলে গোল করে বসে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে জমজমাট আড্ডা।

মিতু আর রবীন ও নাস্তার প্লেট হাতে সবুজ চত্বরে হেঁটে হেঁটে খুঁজতে থাকে পরিচিত কাউকে। হঠাৎ এক জায়গায় চোখ আটকে যায় যায় দুজনেরই। অবাক দৃষ্টিতে দুজনেই তাকিয়ে থাকে রশীদ স্যারের দিকে। আব্দুর রশিদ স্যার। ৯০/৯১ সালে চট্টগ্রাম কলেজের অর্থনীতির শিক্ষক। ছাত্রদের অতি প্রিয় একজন শিক্ষক। মিতু আর রবীন দুজনেই উচ্চ মাধ্যমিকে অর্থনীতির ছাত্র ছিল। সেই সুবাদে রশীদ স্যারের সাথে অনেক গুলো ক্লাস হয়েছে তাদের দুজনেরই। ‌দুজনেই এগিয়ে যায় সামনে। পরম মমতায় স্যারকে সালাম করে পা ছুঁয়ে। দুজনের চোখেই তখন অশ্রু। সেদিনের সেই টগবগে তরুন রশিদ স্যার আজ বার্ধক্যে। চুলগুলো সব পেকে সাদা। হাঁটতে কিছুটা কষ্ট হয়। জীবন পরিক্রমায় আজ তিনি বার্ধক্যে। রশীদ স্যার দাঁড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে রবিনকে। অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে রবীন বলে, স্যার আমি আর আমার স্ত্রী মিতু আমরা দুইজনই আপনার ছাত্র ছিলাম চট্টগ্রাম কলেজে ৯০/৯১ সালে। রবীন আর রশীদ স্যার দুজনেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক পর শিক্ষক ছাত্রের এই সাক্ষাতে দুজনের চোখেই তখন অশ্রু। দুরে‌ দাঁড়িয়ে মিতু ও রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে।

ইতিমধ্যেই দলে দলে আসতে শুরু করেছে প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীরা। অনেক শিক্ষক ও এসেছেন এই মিলন মেলায় যারা এক সময় এই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ভরে যায় পার্কের সবুজ অঙ্গন। চারিদিকে জমে ওঠে সরগরম আড্ডা।

বাঁধন আর ঝুমুর ছুটে বেড়ায় সারাটা অঙ্গন জুড়ে। যার কাছেই যায় সবাই বুকে জড়িয়ে ধরে বাঁধন আর ঝুমুরকে। প্রচন্ড মমতায় আর আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় তাদের। কেউ কেউ তাদের ডাকে আঙ্কেল, কেউ ডাকে আম্মু, কেউ আবার আব্বু। এ যেন‌ বিশাল এক বাড়ী যেখানে রয়েছে তাদের শত শত আপন জন। ইতিমধ্যেই মাঠে দেখা মেলে আরো বেশ কয়েক জন শিশুর। তাদের সাথে বিভিন্ন খেলাধুলায় মেতে উঠে বাঁধন আর ঝুমুর। সব শিশুরা মিলে শুরু করে ওপেনটি বাইস্কোপ খেলা। এরপর লুকোচুরি, চোর পুলিশ আর আরো কত কত খেলা। সবুজ চত্বরে ছোট ছোট দলে আড্ডা রত বড়রা ভীষণ উপভোগ করে ছোটদের সেই ছুটোছুটি।

হঠাৎ ঝুমুরকে কাছে ডেকে নেয় চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এক বয়স্কা অতিথি। পরম মমতায় কোলে তুলে নেয় তাকে। কেন জানিনা আজ সেই বয়স্কা মহিলার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল দেশে থাকা তাঁর ছোট্ট নাতনি রাইমার কথা। ঝুমুরের সাথে তিনি কেমন জানি একটা মিল খুঁজে পান রাইমার। তাঁর মন চাইছিল ঝুমুরকে আদর করে কোলে বসিয়ে আলাপে আর গল্পে কাটিয়ে দিতে কিছুটা সময়। এরই মধ্যে সেই বয়স্কা মহিলা একজনকে দিয়ে পাশের দোকান থেকে বেশ কিছু ফুল কিনে নিয়ে আসে। কয়েকটি ফুল দিয়ে তৈরী করে দুটি গুচ্ছ। ঝুমুরকে কোলে বসিয়ে তার ছোট্ট দুটো বেনীতে গুঁজে দেয় পরম মমতায় নিজ হাতে তৈরী করা দুটো ফুলের গুচ্ছ। আলতো করে চুমু দেয় ঝুমুরের গালে।

এর মধ্যেই জমে উঠেছে সতীর্থ সমাবেশ। কত যুগ পর আজ হঠাৎ দেখা প্রিয় বন্ধু বান্ধবীর সাথে। কথা যেন শেষ ফুরোতেই চায় না। সেই লিচু তলা, সেই রেড বিল্ডিং, গ্যালারি -১, গ্যালারি -২, পি এল টি, জিওগ্রাফি বিল্ডিং, করিডোর, “আলো আরো আলো” লিখা অডিটোরিয়ামের বড় পর্দা, প্রবেশ গেটে দল বেঁধে ঝাল মুড়ি খাওয়া, মেয়েদের কমন রুমের আশে পাশে কারণে অকারণে হাঁটাহাঁটি করে কারো কারো দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা আরো কত কত আলোচনা উঠে আসে এই আড্ডায়। প্রেম নিবেদন, প্রেমে ছ্যাকা খাওয়া, প্রেম পরবর্তী বিয়ে এ বিষয় গুলো ও থেকে থেকে উঠে আসে আলোচনায়। এর ফাঁকে ফাঁকে আবার কেউ কেউ দল বেঁধে অংশ নেয় আয়োজিত খেলাধুলায়।

সময় গড়িয়ে যায় দ্রুত। কারোই খেয়াল নেই সেদিকে। এদিকে বারবার ঘোষণা আসছে দুপুরের খাবার খেতে আসতে। কেউই তাতে গা করছে না। এই স্মৃতিচারণ, এই আড্ডা, এই নস্টালজিয়া থেকে উঠে যেতে কারোই মন চায় না। এরই মধ্যে আবার সবাই সেরে নেয় ব্যাচ ভিত্তিক গ্রুপ ফটো সেশন। এই ছবিটিই হয়তো তাদের সবার জন্য হবে আগামী দিনের এক মহা মূল্যবান স্মৃতিচিহ্ন।

দিন গড়িয়ে ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসে বিকেল। বিকেলের হালকা নাস্তা খেয়ে নেয়ার পর শুরু হয় পুরস্কার বিতরণ পর্ব। ইতিমধ্যেই আমন্ত্রণ জানানো হয় ১০ বছরের নীচের সব শিশুদের। ঘোষণা দেয়া হয় তাদের সবার জন্যেই রয়েছে আকর্ষণীয় পুরস্কার। এই ঘোষণায় ছোট বাচ্চাদের আগমনে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরস্কার বিতরণ পর্ব।

শিশুদের জন্য পুরস্কার হিসেবে রাখা হয়েছে চট্টগ্রাম কলেজেরই এক প্রাক্তন ছাত্রীর “কেনেডি থেকে কিপলিং” এই শিরোনামে লেখা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি বই। বইয়ে কানাডায় সদ্য আগত এক বাংলাদেশী শিশুর ৫০ মিনিটের সাবওয়ে যাত্রায় তার নানান অনুভূতির কথা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে বর্ণিত হয়েছে। বইটি বাচ্চাদের হাতে তুলে দেয়ার আগে লেখিকা বইটি নিয়ে ছোট একটি বক্তব্য দেন। এরপর একে একে সব শিশু কিশোরদের হাতে তুলে দেয়া হয় এক একটি করে বই। বাঁধন আর ঝুমুর ও সামনে এসে লেখিকার কাছ থেকে সংগ্রহ করে তাদের পুরষ্কার।

বিদায়ের সময় আগত। শুরু হয় একে অপরকে আলিঙ্গনের পালা। পিকনিক অঙ্গনের বড় পর্দায় এবার ভেসে ওঠে
“বিদায় বন্ধু বিদায়, দেখা হবে আবার”, এই কথা গুলো। সাথে ধীর লয়ে বেজে ওঠে “পুরনো সেই দিনের কথা” গানটি।

বাঁধন আর ঝুমুর ও ফিরে এসে বাবা, মা আর নানীর সাথে উঠে বসে গাড়ীতে। পুরস্কার হিসেবে পাওয়া বইয়ের সুন্দর প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে থাকে দুজনেই। গাড়ী চলতে শুরু করেছে। বাঁধন আর ঝুমুর উল্টোতে থাকে বইয়ের পাতা গুলো একের পর এক। গাড়ীতে বসেই বইটি পড়া শুরু করে দেয় দুজনেই।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে চারিদিকে। বাঁধন আর ঝুমুর তখন ব্যস্ত “কেনেডি থেকে কিপলিং” বই পড়ায়। আর মিতু আর রবীনের মনে ‌তখন এক বিষাদের কালো মেঘ। দুজনেই ভাবছে মেঘে মেঘে তো অনেক বেলা হয়ে গেলো। কে জানে আগামী বছরের মিলন‌ মেলায় সব সতীর্থকে আবার একসাথে পাবে কিনা। গাড়ী এসে থামে বাড়ীর আঙ্গিনায়। গাড়ী থেকে নেমে পরে সবাই। মিতু আর রবীনের মন তখনো প্রচন্ড স্মৃতিকাতর। মনের আকাশে তখনো তাদের কাটেনি বিষন্নতার কালো মেঘ। স্মৃতির সেলুলয়েডে একের পর এক ভেসে উঠতে থাকে আজ সারাদিনের নানান স্মৃতির কথা। বিষন্নতায় ভরা মন নিয়ে দুজনেই এগিয়ে যায় বাড়ীর মুল ফটকে। আর সাথে নিয়ে যায় বন্ধুদের সাথে হৈ হুল্লোড় করে কাটানো স্মৃতি মূখর একটি দিন।

মোঃ আওরঙ্গজেব চৌধুরী।
টরন্টো, কানাডা
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১।

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
0
0
0
0
0
0
Written by
Aowrangazeb Chowdhury
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!