শুভ্র ও পাউরুটি

-আচ্ছা শুভ্র, তুমি আমাকে বেশি ভালোবাসো নাকি তোমার মাকে?
শুভ্র তখন এক ধ্যানে বইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
-কিছু বললে বাবা?
-হ্যা বলেছি। তুমি যদি তোমার বইটা কিছুক্ষণের জন্য টেবিলের উপরে রাখো তাহলে আবার বলতে পারি।

শুভ্র বইটা টেবিলের উপরে রাখলো। যে পৃষ্ঠায় পড়ছিলো চিহ্ন রাখার জন্য কিছু পেলো না দেখে হাতের পাউরুটি টা সেখানে রেখে দিলো।

-হ্যা বাবা বলো। আমি মন দিয়ে তোমার কথা শুনছি।
-তুমি আমাকে বেশি ভালোবাসো নাকি তোমার মা কে?
শুভ্র দ্বিতীয় বার চিন্তা না করেই বলল,
-মাকে।
-আল্লাহ যদি তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কোরবানি দিতে বলে তুমি কাকে কোরবানি দিবে?
-কাউকে না।
-কিন্তু ইব্রাহীম (আ) তার পুত্র কে কোরবানি দিয়েছিলেন।
শুভ হেসে বলল,

  • আমি তো ইব্রাহীম (আ) নবী না বাবা।

বাবা অন্য কোনো যুক্তি দেয়া যায় কিনা কিছুক্ষণ ভাবলেন। শুভ্র বলল,
-বাবা, তুমি কি আর কিছু বলবে? না বললে আমি একটু পড়তে পারি? আমার দুই মাস পর পরীক্ষা।
-দুই মাস পর পরীক্ষা আর এখন থেকেই ২৪ ঘন্টা বই নিয়ে বসে আছো কেন? আমি তো পরীক্ষার দুই দিন আগে থেকে পড়তে বসতাম।
-এজন্যই তুমি সফল বাবা। আমি পরীক্ষা ছাড়াও বই নিয়ে বসে থাকি। তাই আমি হয়ত তোমার মত এত টাকা পয়সা কামাই করতে পারবো না।
-শুভ্র, তুমি কি জানো তুমি একটা বোকা প্রকৃতির ছেলে?
-হ্যা বাবা।
-কীভাবে জানলে?
-আমি বইটায় চিহ্ন রাখার জন্য বইয়ের মাঝখানে পাউরুটি রেখেছি। কিন্তু আমি ইচ্ছে করলে বইটা উল্টো করে রেখেও চিহ্ন রাখতে পারতাম। আর এই বিষয়টা আমি কাজটা করার পর বুঝেছি। আমার সব বুদ্ধি বইয়েই সীমাবদ্ধ। তাই অন্য ক্ষেত্রে আমাকে বোকাই মনে হয়।
-তোমাকে আমি শেষ আরেকটা প্রশ্ন করতে পারি?
-অবশ্যই।
-তুমি নাকি কালকে রাস্তায় বই পড়তে পড়তে হাঁটছিলে? অল্পের জন্য গাড়ির সাথে ধাক্কা খাও নি।
-হ্যা বাবা। রতন বাঁচিয়ে নিয়েছে।
-রতনকে ধন্যবাদ জানিয়েছো?
-না।
-তোমার উচিত ছিলো রতনকে ধন্যবাদ জানানো।
-ধন্যবাদ জানালে সব ঋণ শেষ হয়ে যাবে বাবা। আমি ওর কাছে ঋণী থাকতে চাই।

শুভ্রর বাবা খেয়াল করলেন বইয়ের মাঝে রাখা পাউরুটি টাই শুভ্র খাচ্ছে। তার ইচ্ছে হলো এক্ষুণি পাউরুটি টা ফেলে দেন। কিন্তু মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়া ঠিক হবে না ভেবে কাজটা শেষ পর্যন্ত করলেন না।

শুভ্রর পাশে রতন বসে আছে। শুভ্রকে সে ভাইজান বলে ডাকে। শুভ্রর এই ডাকটা অসম্ভব ভালো লাগে।

-আচ্ছা রতন তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করলে সত্যি বলবে?
-কী কথা ভাইজান?
-আমি সারাদিনে কি করি না করি তুমি কি সব আমার বাবাকে বলে দাও?
-আজ্ঞে সব না ভাইজান। দুই একটা কথা কই না।
শুভ্র খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কোন কথা বলো না?
-আপনি কখন বাথরুমে যান আর বাথরুমেও যে আপনি বই নিয়া যান ওইটা বড় সাবরে কই না।
শুভ্রর কিছুটা অস্বস্তিকর লাগছে। কথার প্রসঙ্গ পাল্টে সে বলল,
-তোমার কোনো ইচ্ছা আছে? থাকলে বলো। আমি সেটা পূরণ করবো।
-হ ভাইজান। আপনে সারাক্ষণ বই নিয়া বইসা থাকেন। আমার দেখতে খুব বিরক্তি লাগে। আমি চাই আপনে কয়টা দিন বই থেইকা একটু দূরে থাহেন।
শুভ্র হাতে থাকা বইটা খাটের উপর রেখে বলল,
-ঠিক আছে। আগামী ১ মাস আমি বই থেকে দূরে থাকবো।

শুভ্রর বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
-তোমাকে আজকাল বই নিয়ে বসতে দেখছি না। পরীক্ষা কি পিছিয়ে গেলো নাকি?
-না বাবা। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।
-তাহলে পড়তে বসো না কেন?
-আমি রতনকে প্রমিস করেছি আগামী ১ মাস বই হাতে নিবো না। বই থেকে দূরে থাকবো। ওর নাকি আমাকে সারাক্ষণ বই হাতে দেখতে বিরক্ত লাগে।

শুভ্রর বাবা রাগে চুপ করে থাকলেন। নিস্তব্ধতা ভাঙার জন্য শুভ্র বলল,
-আচ্ছা বাবা, তোমাকে যদি সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি দিতে বলা হয় তুমি কাকে কোরবানি দিবে?
-আমি প্রতিবছর গরু কোরবানি দেই তুমি জানোনা?
-সেটা তো তোমার প্রিয় না বাবা। তুমি গরুকে নিজের হাতে কখনো খাইয়েও দাওনি। তার প্রতি তোমার কোনো টানও তৈরি হয় না। আচ্ছা, তুমি কি আমাকে কোরবানি দিতে পারবে?

কথাটায় তার চোখে পানি টলমল করে উঠলো। চোখের পানি লুকিয়ে শুভ্রর বাবা বললেন,

  • তুমি তো আর স্বামী বিবেকান্দ না যে একবার পড়লেই সব মনে থাকে। তুমি এবারের পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারবে না বুঝতে পারছো সেটা?
    -হ্যা বাবা
    -তোমার কি ফার্স্ট হতে ভালো লাগে না?
    -রতন কি বলেছে জানো বাবা?
    রতন কি বলেছে সেটা জানার ইচ্ছা না থাকলেও তিনি বললেন,
    -কি?
    শুভ্র রতনের গলা অনুকরণ করে বলল,
    -প্রত্যিকবার ফাস্ট হইলে ফাস্ট হওয়ার মজা থাকে না। মাঝে মইধ্যে সেকিন্ড থার্ট ও হওয়া লাগে। বেশি ভালো হয় একবার ফেল করলে। ওর মুখে কথাগুলি আরো সুন্দর লাগে। আমি ঠিক ভাবে বলতে পারছি না। আমি ঠিক করেছি এবারের পরীক্ষায় ফেইল করে দেখি। পরের বার ফার্স্ট হলে হয়ত বেশি মজা লাগবে।

শুভ্রর বাবা দাঁত কিড়মিড় করে জিজ্ঞেস করলেন,
-তুমি কি জানো তুমি অনেক নির্বোধ একটা ছেলে?
শুভ্র হেসে বলল,
-আমি জানি বাবা।

শুভ্রর রেজাল্ট দিয়েছে। যথারিতি শুভ্র এবারেও ফার্স্ট হয়েছে। কিন্তু শুভ্রর মন খারাপ। শুভ্রকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে শুভ্রর বাবা জিজ্ঞেস করলেন,

-রেজাল্ট দিয়েছে শুনলাম। নিশ্চয়ই ফেইল করেছো?
শুভ্র মন খারাপ করেই বলল,
-না বাবা। ফার্স্ট হয়েছি।
শুভ্রর বাবা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,
-সত্যি!! তাহলে মন খারাপ করে আছো কেন?
-আমি ভেবেছিলাম একবার ফেইল করে দেখি যারা ফেইল করে তাদের কেমন লাগে। কিন্তু ভুল করে পরীক্ষায় যেসব পশ্ন কমন এসেছিলো সবগুলির উত্তর দিয়ে ফেলেছি।
শুভ্রর বাবা মনে মনে বললেন, ‘ইডিয়ট’।
শুভ্র হয়ত তার মনের কথা শুনলো।
শুভ্র বলল,
-বাবা, তুমি আমাকে সরাসরিই ইডিয়েট বলতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না।

(সমাপ্তি)

শুভ্রপাউরুটি

অরণী_মেঘ ( Oroni Megh)

(ফ্যানপোস্ট হুমায়ূন আহমেদ এর শুভ্র)

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
0
0
0
0
0
0
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!