ক্লিপ্টোম্যানিয়াক পর্ব ১৬

১৬

কলিং বেল বাজল। মনে হচ্ছে ছেলেপক্ষ এসে গেছে। মা গিয়ে দরজা খুললেন। কিচির মিচির আওয়াজে বুঝে গেলাম, ওরাই। মনে হচ্ছে ছেলেপক্ষের মহিলারা শুধু। পুরুষড়া সম্ভবতঃ নামাজে গেছে। সো অফিসিয়াল অনুষ্ঠান শুরু হবে আরও ঘণ্টা খানেক পরে। অবশ্য যদি মহিলাদের কেউ আমার সাথে দেখা করতে ভেতরে আসতে না চায়। কি হবে জানি না, শম্পাদি দেখলাম বিরক্ত। ‘আসার আর সময় পেল না’ টাইপ একটা মুখ করে বসে আছে। কারণ আমাদের গল্প এখন মাঝপথে। শম্পাদি প্রথমে যদিও শুনতে চাইছিলেন না, এখন দেখলাম বাকীটা শুনতে উদগ্রীব। বলল

— তাড়াতাড়ি শেষ কর।

— আর কি বলব?

— আরে, ও জানল কিভাবে যে প্রলয় তোকে ইনসাল্ট করেছে?

— ও। সৈকত তখন ওখানেই ছিল।

— মানে? ওখানে কাজ করে?

এমন সময় মা এসে শাড়ি দিয়ে গেলেন। ছেলেপক্ষ এনেছে। জামদানী। হালকা নীল রঙয়ের। শম্পাদি নেড়ে চেড়ে দেখলেন। মা চলে যাওয়ার পরে বললেন

— ছেলের পছন্দ আছে।

মেনে নিলাম। আসলেই শাড়িটা সুন্দর। কিন্তু কথাটায় যতটা খুশি হওয়ার কথা, ততোটা খুশি আসল না চেহারায়। প্রায় ম্লান একটা হাসি হাসলাম। সেই সাথে টের পেলাম হঠাৎ করে অস্থিরতাটা আবার ফিরে এসেছে। যেকোন সময় একটা রূপকথার ইতি ঘটবে। এতক্ষণ গল্প করতে গিয়ে খারাপ লাগাটা ভুলে ছিলাম, বা বলা যায় সেভাবে অস্থির করছিল না। ব্যাপারটা টের পেয়ে কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলাম। একবার মনে হল, সত্যিই কি ভুল করছি? 

— নে শাড়ি খোল।

শম্পাদি কখন উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসেছেন টের পাইনি। মনে হচ্ছে আমাকে শাড়ি পড়াবেন বলে দরজা বন্ধ করলেন। বাকী গল্পটা কি আর শুনবেন? উনার চেহারা দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম। আমার দিকে তাকালেন। আমি তাকিয়ে আছি দেখে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কি হল?’। শম্পাদির দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি হাসলাম। 

— হাসছিস কেন?

— ভাবছি তুমি শুধু গল্প শুনেই এক্সাইটেড। আমার কথা ভেবেছো? অ্যান্ড আই ওয়েন্ট থ্রু দ্যা হোল সিচুয়েশান। 

ছেলে পক্ষের দেয়া শাড়িটা খুললেন। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

— তুই তো মনে হচ্ছে প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস। নে এখন গায়ের শাড়িটা খোল। আর গল্প বলতে থাক।

— কি বলব?

— মানে? ও জানল কি করে যে প্রলয় তোকে ইনসাল্ট করেছে?

— তুমি তো দেখি গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছো।

— গোয়েন্দাগিরি না, বোঝার চেষ্টা করছি, ছেলেটার মনে কি আছে।

— কি থাকবে আবার?

— সে পরে ভাবা যাবে। এখন শুরু করেন।

আমার ততোক্ষণে শাড়ি খোলা হয়ে গেছে। বরপক্ষের দেয়া শাড়ি পড়তে শুরু করেছি। 

শম্পাদি তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। 

— কি দেখো?

— বোঝার চেষ্টা করছি

— কি?

— কাকে তোর পাশে বেশি মানাবে।

কুচি দিচ্ছিলাম। থেমে গেল হাতটা। নিজের অজান্তেই বড় একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল। এরপরে বললাম

— অপশান তো একটাই।

আমার দীর্ঘশ্বাস মনে হয় না উনার নজর এড়ালো। তবে মুখে কিছু বললেন না। শুধু বললেন।

— বাকীটা কি বলতে ইচ্ছে করছে না?

তাকালাম উনার দিকে। আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। শোনার ইচ্ছে আছে, কিন্তু জোর করে শুনতে চান না। বললাম

— নাহ। বলছি। 

এরপরে বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠেই শুরু করলাম

— সেদিন, মানে সৈকতকে যেদিন প্রথম দেখি, সেদিন তো ও ক্যাফে থেকে বের হওয়ার পরে আমি বেরোই। যদিও মিনিট দশেক পরে। তারপরও একটা মজার কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। প্রলয়দের বুটিকের পাশেই ও বসে সিগারেট খাচ্ছিল। হয় পিঠ আমার দিকে ছিল, বা আমি লক্ষ্য করিনি। যেটাই হোক, ও আমাকে দেখে, বাট আমি ওকে দেখিনি।

— বুঝলাম, তারপর?

উনার অস্থিরতা দেখে হাসলাম। তবে কাহিনী চালিয়ে গেলাম।

— তো আমাকে ওখানে দেখে সৈকত ভাবে যে আমি বোধহয় ওকে ফলো করছি। জাস্ট একটু আগে চুরি করেছে, তাই… 

— তারপর?

— যাই হোক, আমাকে দেখেই লুকিয়ে যায়। তবে সন্দেহ যায় না। ঘটনা কি, সেটা বোঝার জন্য, লুকিয়ে আমাকে ও ফলো করে। দেন…

— প্রলয় তোকে চোর বলে, এটা ও দেখে ফেলে। এই তো?

— ইয়েস। 

— ও। এরপরে সেইম পিঞ্চ! চোরে চোরে মাসতুতো… 

— নো। ভাই বলবে না।

হেসে ফেলল শম্পাদি। আমার ততোক্ষণে শাড়ি পড়া হয়ে গেছে। বিছানায় বসলাম। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল শম্পাদি। মনে হচ্ছে উনার মাথায় কিছু চলছে। একসময় দেখলাম চোখ শক্ত হয়েউ উঠল। এরপরে বিছানায় আমার পাশে বসল। বলল

— ছেলেটাকে এক্ষুনি ফোন কর।

— মানে?

— মানে তোকে বুঝতে হবে না। এই এনগেজমেন্ট হবে না। আন্টিকে আমি বোঝাব। দরকার হলে সোহরাব সাহেবের সাথেও আমি কথা বলব।

— পাগলামি করো না।

— কোন পাগলামি করছি না। জাস্ট রিং হিম।

— বললাম না, ওর অ্যাফেয়ার আছে।

কথাটা বোধহয় ভুলে গিয়েছিল। উৎসাহে কিছুটা ভাটা পড়ল। এরপরে কিছুটা সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল

— ‘অ্যাফেয়ার’ কথাটা বলেছে তোকে?

— সর্ট অফ। যখন জিজ্ঞেস করলাম, রিংটা কার জন্য কিনছে, তখন বলল, টু বি ওয়াইফ।

— টু বি ওয়াইফ মানে কি অ্যাফেয়ার? তা তো না। সেটল ম্যারেজও তো হতে পারে। তোর মত। 

— হতে তো পারে, তাই বলে…

— গার্ল ফ্রেন্ড তো বলেনি।

— না তা বলেনি, বাট…

— কোন বাট না। তুই ফোন কর।

এমন সময় ব্যাপারটা মনে হল। শম্পাদির দিকে তাকিয়ে কোনরকমে বললাম

— কিন্তু ওর  নম্বর তো নেই।

— নেই মানে? চাস নি?

মাথা দুদিকে নেড়ে বোঝালাম ‘না’। এমন সময় মনে পড়ল কথাটা। বললাম

— আনিস সাহেবের কাছে থাকতে পারে। উনিই তো ওকে হায়ার করেছিলেন।

কথাটা বলেই বুঝলাম, ভুল করে ফেলেছি। শম্পাদিকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলাম, আমার মনে কি চলছে। উনার ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠল। বললেন

— তো ওয়েট করছিস কেন? লাগা ফোন।

এখন আর ঘোমটা দেয়ার সুযোগ নেই। নাচব যখন ঠিক করেই ফেলেছি, তখন… ড্রেসিং টেবিলের ওপর ফোনটা পড়ে ছিল। দ্রুত ফোনটা হাতে নিলাম। ফোনের আইকনটায় ছাপ দিলাম। এরপরে কন্টাক্টের সার্চ অপশানে আনিস টাইপ করতে করতে বললাম

— যদি অ্যাফেয়ার থাকে?

শম্পাদি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় আবার কলিং বেলটা বাজল। সেটা শুনে শম্পাদির দিকে তাকালাম। ভয়ে ভয়ে বললাম

— নামাজ বোধহয় শেষ।

— হোক শেষ। তুই ফোন লাগা।

টাইপ করে ফেলেছি। চোখের সামনে নাম। আঙ্গুল কাঁপছে। যদি পেয়েও যাই ফোন নম্বর, কি বলব? এমন সময় মায়ের আওয়াজ পেলাম

— মিনু। হয়েছে তোর?

এতো দ্রুত ড্যাকতে আসার কথা না। ছেলেরা আসলেও এই মুহূর্তে মায়ের কাজ হচ্ছে ওদের বসতে বলা, গল্প করা, এসব। তাছাড়া মায়ের আওয়াজ ঠিক মোলায়েম না। অবাক হয়ে শম্পাদির দিকে তাকালাম। শম্পাদিরও ভ্রু কুঁচকে গেছে। ‘হয়নি’ বলে আওয়াজ দেয়া যেত। কিন্তু উনি সেটা করলেন না। উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। সাথে সাথে ঝড়ের বেগে মা ঢুকলেন ঘরে। রীতিমত উদ্ভ্রান্ত চেহারা। ‘কি ব্যাপার?’ প্রশ্নটা করার সুযোগ পেলাম না। মা গর্জে উঠলেন 

— কি শুরু করেছিস তুই?

— আমি আবার কি করলাম?

— কি করলাম মানে? তোকে আমি জিজ্ঞেস করিনি, এই বিয়েতে রাজী না থাকলে বল?

অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। এরপরে শম্পাদির দিকে তাকালাম। মা মনে হচ্ছে এখন কেঁদে ফেলবে। মায়ের কাঁধে হাত রাখলাম। বললাম

— প্লিজ মা। কি হয়েছে খুলে তো বলবে।

মা এবার শম্পাদির দিকে তাকিয়ে বললেন

— দেখো তো কেমন লাগে। ছেলেপক্ষ এসে বসে আছে আর এই সময় এসে হাজির হয়েছে। বলছে একবার শুধু মিনুর সাথে কথা বলবে।

একবার মনে হল বেরিয়ে গিয়ে দেখি, কে এসেছে। একবার তাকালামও দরজার দিকে। মা বোধহয় টের পেলেন আমি বাইরে বেরোবার চিন্তা করছি। ধমক দিয়ে উঠলেন

— খবরদার। ওঘরে যাবি না।

— বাট কে এসেছে, সেটা তো বলবে?

— কে আবার, ঐ হারামজাদা।

এই ফাঁকে শম্পাদি বেরিয়ে গেলেন। একটু পরে ফিরে এলেন। উনারও মুখ গম্ভীর। আমি মুখে কিছু না বলে ইশারায় জানতে চাইলাম, কে এসেছে। উত্তরে আওয়াজ না করে শুধু ঠোঁট নাড়িয়ে শম্পাদি শব্দটা উচ্চারণ করলেন। বুঝে গেলাম। মুহূর্তে মেজাজ বিগড়ে গেল। 

এমন সময় ‘আমার হয়েছে যত জ্বালা’ বলে রাগে গজগজ করতে করতে মা বেরিয়ে গেলেন। মা চলে গেলে শম্পাদির দিকে তাকালাম। বললাম

— বিশ্বাস কর, আমি গতকাল স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলেছি, ইট ইজ ওভার। 

— শুধু একবার কথা বলতে চাইছে।

— কি বলবে?

— সেটা বলল না। শুধু বলল বেশি সময় নেবে না। শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করেই চলে যাবে। 

— বললে না, আজ আমার এনগেজমেন্ট?

— বলেছি। শুনছে না। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

প্রমাদ গুনলাম। এখনই ছেলেরার নামাজ পড়ে এসে যাবে। আর এসে যদি দেখে দরজায় প্রাক্তন প্রেমিক দাঁড়িয়ে আছে, কি বিচ্ছিরী অবস্থা হবে? অস্থির পায়চারী শুরু হয়ে গেছে আমার। ঘামছি। দ্রুত ভাবছি কি করা যায়। ফোন করে বলব, চলে যেতে? শুনবে? শম্পাদির দিকে তাকালাম। উনার মুখও ভয়ে পাংশু হয়ে গেছে। 

মনে হচ্ছে প্রলয়কে গিয়ে একটা চড় লাগিয়ে আসি। ও পেয়েছে কি? এমন সময় মা আবার ঘরে আসলেন। মুখে আর কোন রাগ নেই। বরং মুখ এখন ফ্যাকাসে। মায়ের চেহারা দেখে আমারও মুখ থেকে রক্ত সরে গেলে। মনে হল আমারও হার্ট বন্ধ হয়ে যাবে। কোনভাবে জিজ্ঞেস করলাম

— কি হয়েছে?

অস্ফুটে মা শুধু বলতে পারলেন

— সোহরাব তোকে ডাকছে।

চলবে

Razia Sultana Jeni

Send private message to author
What’s your Reaction?
2
2
0
1
0
0
0
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!