আমাদের যাদের জন্ম পঞ্চাশ আর ষাট দশকের মাঝামাঝি বা তার ও খানিকটা পরে তাদের শৈশব আর কৈশোর কেটেছে স্বপ্নময় এক নির্মল আনন্দে। সে সময়টাতে পরিবার গুলোতে আর্থিক প্রাচুর্য তেমন ছিল না। তবে অভাবের তাড়নাটা ও লক্ষণীয় ভাবে প্রকট ছিল না। আন্তরিকতায় ভরা মানুষের জীবন ছিলো সহজ সরল আর সাদামাটা। কাছের, দূরের, আত্মীয়, অনাত্মীয় সবাই ছিল এক একটি বড় পরিবারের সদস্যের মতো। পারস্পারিক হিংসা বিদ্বেষ, মানুষের প্রতি অন্যায়, অবিচার, নির্মমতা এ গুলো ছিলোনা বললেই চলে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, সহমর্মিতা, কারো বিপদে অন্যের এগিয়ে আসা, সামাজিক অনুষ্ঠানে সবাই মিলে নিঃস্বার্থভাবে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করা এ গুলো ছিল তখনকার গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার একটি নিত্যদিনের চরিত্র। আপন পর নির্বিশেষে যে কোন বয়স্ক ব্যক্তিদেরকে সবাই মুরুব্বী হিসেবে সম্মান করতো, মেনে চলতো তাঁদের দেয়া আদেশ নিষেধ আর উপদেশ।
আমাদের শৈশব ছিল অত্যন্ত আনন্দ আর স্মৃতিময়। প্রতিটা মুহূর্ত ছিল আমাদের নির্মল আনন্দের। তখন বাংলাদেশ ততটা শহরময় হয়ে ওঠেনি। হাতে গোনা চার পাঁচটি বড় বড় শহর ছাড়া ছোট ছোট শহর গুলো ও ছিল অনেকটা গ্রামীণ আদলে গড়া। শৈশবে আমরা দল বেঁধে হরেক রকম খেলা খেলতাম। এ গুলোতে খরচের তেমন বালাই ছিল না। প্রায় শতভাগ খেলাই ছিল খরচ বিহীন। খেলাধুলার বাইরে বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ও আমরা প্রচুর আনন্দ পেতাম। আমাদের খেলাধুলা আর আনন্দ গুলো ঘর কেন্দ্রিক ভিত্তিক ছিল না। বেশীর ভাগ খেলাধুলা আর আনন্দ অনুষ্ঠান ছিল বাড়ীর বাইরে, উঠোনে, বাড়ীর আঙ্গিনা আর আশেপাশে। আসুন আমাদের সময়কার কিছু কিছু খেলাধুলা আর আনন্দের উপাদানের সাথে পরিচিত হই।
পুকুরে ডুব সাঁতার দেয়া, চাঁদা তুলে ফুটবল খেলা, দল বেঁধে গল্প গুজব আর দুষ্টুমি করতে করতে ক্ষেতের আল দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাওয়া, দাড়িয়াবান্ধা গোল্লাছুট, পুকুর খাল বিল নদীতে জাল বা বরশি দিয়ে মাছ ধরা, অনেকক্ষণ ধরে ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে ভেজা, পুকুরে গোসল করতে গিয়ে মাঝে মাঝে একেবারে কম বয়সী ছেলেদের কেউ কেউ লুঙ্গি খুলে পুকুরের পাড়ে তা রেখে পানিতে ঝাঁপ দেয়া, লুঙ্গিকে ফুলিয়ে এর ভিতরে বাতাস ঢুকিয়ে পুকুরের মাঝ খান অবদি চলে যাওয়া, এক্কাদোক্কা, বর্ষাকালে উজানে হেঁটে যাওয়া কৈ মাছ ধরা, কুতকুত, চোর পুলিশ, দল বেঁধে মক্তবে পড়তে যাওয়া, কলা গাছের ভেলায় নৌকা বানিয়ে পুকুরে বা অন্যান্য জলাশয়ে ভাসা, মার্বেল খেলা, জাম্বুরা দিয়ে ধান ক্ষেতে ফুটবল খেলা, লুকোচুরি, ১৬ গুটি, লুকানো কাউকে খুঁজে বের করা, লুডু, গুলাইল দিয়ে নিশানা ভেদ করা, বিভিন্ন রঙের ঘুড়ি ওড়ানো, লাঠি খেলা, ওপেনটি বাইস্কোপ, পুতুল বিয়ে দেয়া, ডাংগুলী, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, লাটিমের গোড়ায় সুতো বেঁধে সেটা ঘুরানো, গুটি খেলা, সাতছড়া, সেহরিতে গান গেয়ে গেয়ে লোক জাগানো, পূকুরে ডুব দিয়ে পুকুরের নীচ থেকে মাটি তুলে নিয়ে আসা, জ্যোৎস্না রাতে বড়দের সাথে গ্রামের এ বাড়ী ও বাড়ী বেড়াতে যাওয়া এ রকম আরো নানান রকম নির্মল আনন্দে ভরপুর ছিল আমাদের শৈশব আর কৈশোর।
সকালে ঘুম থেকে উঠে কয়লা বা ছাই দিয়ে দাঁত মেজে অজু করে মাথায় টুপি দিয়ে হাতে কায়দা, সিপারা বা কোরান শরীফ নিয়ে আর সাথে বগলের নীচে বসার জন্য ছোট্ট একটা পাটি নিয়ে আমরা দল বেঁধে যেতাম মক্তবে আরবী শেখার জন্য। মক্তব থেকে এসে আমরা প্রস্তুত হতাম স্কুলে যাবার জন্য। গোসল সেরে গরম গরম ভাত খেয়ে দল বেঁধে আমরা আনন্দ করতে করতে স্কুলে যেতাম। মায়েরা তখন আমাদের চুলে সরিষার তেল মেখে দিতেন। মাঝে মাঝে তেলের আধিক্যের কারণে আমাদের চুল বেয়ে তেল পড়তো গড়িয়ে গড়িয়ে।
স্কুল নিয়ে আলোচনা করলে আমাদের শিক্ষকদের কথা স্বভাবতই প্রসঙ্গ ক্রমে এসে যায়। তখনকার সময়ে হাইস্কুল গুলো ছিল গড়ে চার পাঁচ মাইল দূরত্বে। আমরা তখন হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম। কাছাকাছি স্কুলের কোন শিক্ষকের বাড়ী থাকলে আমরা গ্রামের ছেলে মেয়েরা সেই স্যারের বাড়ীতে যেয়ে অপেক্ষা করতাম। আর স্যারের সাথে দল বেঁধে স্যারের পিছু পিছু স্কুলে যেতাম। সে সময় দেখেছি অজ পাড়াগাঁয়ের স্কুল গুলোতে ও অত্যন্ত মেধাবী আর গুনী শিক্ষকের সমাহার। সে সময় গ্রামের স্কুল থেকেও অনেক ছাত্র ছাত্রীকে বিভিন্ন পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান পেতে দেখেছি। শিক্ষার বাণিজ্যী করণ তখন ছিল না একেবারেই। শিক্ষকরা যেমন ছাত্রদের কড়া শাসন করতেন, আদব কায়দা, চরিত্র গঠন শিক্ষা দিতেন আর এর সাথে সাথে দেখেছি গরীব আর মেধাবী ছাত্রদের জন্য শিক্ষকদের এক আন্তরিক ভালোবাসার ছোঁয়া। এ সমস্ত ছাত্রদেরকে শিক্ষকরা নিজের বাড়ীতে ডেকে নিয়ে বিনে পয়সায় পড়াতেন আর নিশ্চিত করতেন তাদের ভালো ফলাফল। শিক্ষকদের বেতন তখন খুবই অল্প ছিল। ছিলনা সে সময়ে টিউশনীর কোন ব্যবস্থা। কিন্তু ছাত্রদের জন্য শিক্ষকদের ছিলো এক প্রচন্ড ভালোবাসা। অনেক শিক্ষককেই দেখেছি সে সময় নিজের ব্যক্তিগত সময়ে ছাত্রদেরকে ডেকে নিয়ে বিনে পয়সায় পড়াতে। আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান সে সময়টায় আমরা এ রকম অনেক গুনী আর ত্যাগী শিক্ষকদের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি।
স্কুল থেকে ফিরে এসে আমরা আবার ভাত খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিতাম। এরপর ঘুম থেকে জেগে পুরো বিকেলটা কাটতো আমাদের বেশ আনন্দে। ছেলে, মেয়ে, শিশু, কিশোর সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়তো কোন না কোন খেলায়। সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের আগেই আমরা ফিরে আসতাম যার যার বাড়ীতে। জ্বালানো হতো হারিকেন আর কুপি বাতি। শুরু হতো আমাদের রাত্রি কালীন পড়াশোনার প্রস্তুতি। বাড়ির কাছারী ঘরে লজিং থাকা গৃহ শিক্ষকের কাছে আমরা দল বেঁধে পড়তে যেতাম তখন।
সে সময়টাতে আমাদের অনেকের জীবনে বিলাসিতা আর সৌখিনতা ছিল না। বেশীর ভাগ মানুষই ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। প্রায় সকলেরই জীবন চলতো তখন সৎ উপার্জনে। পরিবার গুলোর আয়তন ছিল বেশ বড়। এক একটি পরিবারের ছেলে মেয়ের গড় সংখ্যা ছিল ৬/৭ জন। এই টানা পোড়েনের মধ্যে ও আমাদের জীবনটা চলে যেত হাসি খুশীতে আর আনন্দে। আমাদের সবারই ছিল নিজের জিনিস অন্যের সাথে ভাগ করে নেয়ার মন মানসিকতা আর এতে আমরা পেতাম এক অপার আনন্দ। আমরা একে অপরের জামা কাপড়, জুতা সেন্ডেল শেয়ার করতাম। পিঠা পিঠি ভাইবোন হলে এক সেট পুরনো বই দিয়ে দুজনেই পড়াশোনা চালাতাম।
প্রতিদিন বাড়ীতে খুব ভালো তরকারী রান্না হতো না। যখনই বাড়ীতে মুরগী, গরু, খাসির মাংস বা বড় মাছ রান্না হতো তখন এই সীমিত তরকারী দিয়ে ও আমরা সবাই সুন্দর ভাবে ভাগ জোক করে খাওয়া সেরে নিতাম। কেমন করে জানি না তখনকার মায়েরা এই অল্প তরকারী দিয়ে সবাইকে সুন্দর করে খাওয়াতে পারতেন। খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট ছিল তখনকার শিশু কিশোররা। সে সময়কার শিশু কিশোরদের একেবারে সাধাসিধা আর চাকচিক্য হীন শৈশব কৈশোর থাকলে ও ছিলোনা ভালোবাসা আর আনন্দের কোন অভাব। তাদের বর্ণময় সেই শৈশব ছিল মায়া মমতা, আদর ভালোবাসা আর আনন্দে ভরপুর।
মাঝে মাঝে বাড়ীতে মেহমান আসতেন। মেহমান অবস্থান কালীন সময়টা ছিল আমাদের জন্য খুবই আনন্দের। মেহমান বেড়াতে আসার সময় বিস্কুট, চকলেট, (চকলেটকে তখন অনেকেই লেবেঞ্চুস বলতো), চানাচুর জাতীয় খাবার নিয়ে আসতেন। এ সময় মেহমানদের জন্য ভালো কিছু রান্না বান্না হত। বাড়ীর পুকুরে জাল দিয়ে ধরা হতো মাছ। আমরা ছোটরা মাছ রাখার পাত্র নিয়ে পুকুরের চারপাশে ঘুরতাম। জালে বড় রুই কাতলা ধরা পড়লে আমাদের মনটা আনন্দে ভরে যেত। মেহমানদের উপস্থিতির কারণে আমাদের উপর বাড়ীর বড়দের দেয়া নিয়ম কানুনে কিছুটা শিথিলতা দেখা যেত এই সময়টায়। সে সময়ে রান্না ঘরে মেহমানদের সাথে পাটিতে বসে সবাই একসাথে খেতে বসতাম। সমবয়সী মেহমান হলে রাতে আমরা একই বিছানায় ঘুমাতাম আর রাজ্যের গল্প করতে করতে রাতের অনেকটা সময় পেরিয়ে যেতো আমাদের।
একান্নবর্তী পরিবারে আমাদের সব চাইতে বড় বন্ধু ছিল দাদা দাদী। কোন ভুল ত্রুটি আর ছোট খাটো অপরাধের কারণে যখন বাবা মা আমাদের শাসন করতেন বা কখনও কখনও মারতে উদ্যত হতেন সেই সময় দাদা দাদীরা এসে আমাদের উদ্ধার করতেন। প্রায় ক্ষেত্রেই দাদা দাদীর কাছে একটি গোপন টাকার বাক্স থাকতো। দাদা দাদী দের সেই গোপন ব্যাংক থেকে মাঝে মাঝে বিশেষত মা বাবার মার খাওয়ার পর কান্না করার সময় আমরা এক আনা দুই আনা পেতাম। কোন ভুল ত্রুটি করলে আগে ভাগেই আমরা দাদা দাদীকে বলে রাখতাম যাতে করে বিপদের সময়ে এসে তাঁরা আমাদেরকে উদ্ধার করতে পারেন। দাদা দাদির প্রতি অজানা এক ভালোবাসার কারণে ছোটদের অনেককেই দেখেছি দাদা দাদির সাথে রাতে এক সাথে ঘুমোতে। ঘুমাতে যাবার সময় দাদা দাদি দের কাছ থেকে এই সমস্ত ছোট বয়সীরা নানান রকমের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তো।
মাঝে মাঝে আমরা আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে বেড়াতে যেতাম। বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা হলে সাথে সাথেই শুরু হয়ে যেত আমাদের প্রস্তুতি। বেড়াতে যাবার কথা মনে আসলেই আনন্দে আমাদের রাতে ঘুম আসতো না। বেড়াতে যাওয়ার জন্য তেমন বিশেষ কোন জামা কাপড় থাকতো না। জামা কাপড়ের তেমন কোন বাহুল্য ও ছিলনা তখন। হাফ শার্ট, পায়জামা আর পায়ে দুই ফিতার স্পঞ্জের স্যান্ডেল এ গুলোই ছিল সাধারণত আমাদের পরিধেয়। মাঝে মাঝে কেউ কেউ গায়ে পাউডার আর মুখে স্নো মাখতেন। কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানীর তিব্বত স্নো আর তিব্বত পাউডার তখনকার প্রসাধনীর মধ্যে ছিল অন্যতম। বেড়াতে গেলে আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে আমাদের ব্যাপক সমাদর হতো। রান্না হতো ভাল ভাল খাবার আর নাস্তা। আত্মীয় বাড়ীর ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াতাম সারা পাড়াময়, গ্রামময়। নিজ বাড়ীর মতো বাবা মায়ের শাসন ছিলোনা আত্মীয় বাড়ীতে বেড়ানোর এই সময়টায়। ছিলনা কোন নিয়ম কানুন আর বাঁধা নিষেধের বেড়জাল। পরিবেশ ছিল অনেকটা এরকম।
“কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা।”
এই সময়টা আমরা এই তত্ত্বটি পুরোপুরি কাজে লাগাতাম। আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে বেড়াতে যাওয়ার আরেকটি লাভজনক দিক ছিল। ফিরে আসার সময় আমরা সবাই এক আনা, দুই আনা বা ভাগ্য ভালো হলে কেউ কেউ আবার মাঝে মাঝে চার আনা ও পেতাম।
ঈদ ছিল তখনকার সময়ে আমাদের আনন্দের সবচাইতে বড় উপলক্ষ। ঈদে আমরা নতুন জামা কাপড় পেতাম। দু ঈদেই যে আমরা নতুন জামা কাপড় পেতাম সেটা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে আমরা ছোটরা নতুন জামা কাপড় দুই ঈদে ভাই বোনদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতাম।
একান্নবর্তী পরিবার, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনদের সাথে আমাদের শৈশব কেটেছে নির্মল আনন্দে আর ভালোবাসায়। অতি অল্পতেই তুষ্ট ছিলাম আমরা তখন। আর্থিক স্বচ্ছলতা তেমন ছিল না তখন পরিবার গুলোর। কিন্তু আমাদের চারিদিকে ছিলো সবার আদর, স্নেহ আর ভালোবাসার এক শীতল ছায়া। আপন পর নির্বিশেষে সবাই ছিল অতি কাছের পরম আপনজন। মধুময় সেই আনন্দে ঘেরা আমাদের শৈশব আর কৈশোর আজো আমাদের স্মৃতিতে হানা দেয় বার বার। ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় আবারো আমাদের সেই স্বর্ণালী শৈশবে।
টরন্টো, কানাডা।
৩ জুলাই ২০২১।
আমার শৈশব কেটেছে ঠিক এইভাবেই। লেখাটি পড়ে যেন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম।