গল্প: শিউলিফুল


‘কতবার বললাম, জানালার পর্দাটা একটু টেনে দে! কথা কি কানে যায় না?’
-খুব কর্কশ কণ্ঠে কথাগুলো বললো আফজাল সাহেব। লোকটার বয়স হওয়াতে মেজাজ আরো খিটখিটে হয়েছে।

খাদিজা এসে জানালার পর্দা টেনে দিলো। খাদিজা এই বাড়ির কাজের মেয়ে। দীর্ঘ পনেরো বছর যাবত এই বাড়িতেই আছে। এই পনেরো বছরে আফজাল সাহেব এর ধমক শুনে অন্তত বিশবার রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু আফজাল সাহেবের অনুরোধে আবার ফিরেও এসেছে।

আসলে আফজাল সাহেব অনুরোধ করার মানুষ নয়। উনার বাড়িতে অন্য কোন কাজের মেয়েই দুই একদিনের বেশি থাকতে পারে না। ধমক খেয়ে সবাই পালিয়ে বাঁচে।

উপায় না পেয়ে খাদিজাকেই আবার অনুরোধ করে নিয়ে আসে।

‘একটু চা বানিয়ে আন তো।’ খাদিজাকে বললেন আফজাল সাহেব।

খাদিজা দ্রুত চা নিয়ে এসে দাড়িয়ে রইলো। আফজাল সাহেব অর্ধ শোয়া থেকে উঠে বসলেন। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিয়ে বললেন,

  • দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কিছু বলবি?

খাদিজার শরীর কাঁপছে। আমতা আমতা কণ্ঠে বললো,

  • স্যার, আপনার মেয়ে আইছিলো। একটা চিঠি দিয়া গেছে।

আফজাল সাহেব চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন,

  • চিঠিটা চুলোয় দিয়ে পুড়ে ফেল। আর শোন, তোর চা বানানো এখন আগের থেকে ভালো হয়। আরেক কাপ চা নিয়ে আয়।

খাদিজা চা বানাতে চলে গেলো। এবার চায়ের কাপের নিচে চিঠিটা ভাজ করে আফজাল সাহেবের টেবিলে রেখে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়লো। খুব সময় নিয়ে বাজার করে তারপর ফিরবে। এতক্ষণে আফজাল সাহেবের রাগ নেমে যাবে।

আফজাল সাহেব চা’য়ে চুমুক দেওয়ার সময় চিঠিটা হাতে লাগলো। সাথেসাথেই রাগে চিৎকার দিয়ে খাদিজাকে ডাকলো। খাদিজার সাড়া না পেয়ে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে বললো,

  • তোর মনে হয় এটা আমার মেয়ের চিঠি? ওর মা এখন মেয়েটাকে পিয়ন বানিয়েছে। বুড়ো বয়সে তার ভালোবাসা উপচে পড়ছে। আমি বেঁচে থাকতে এই বাড়িতে ওর জায়গা নেই।

আফজাল সাহেব চা খাওয়া অসমাপ্ত রেখে চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন,

প্রিয় রাগী মানুষ,

আশা করি, রাগ আগের মতোই আছে। আমিও চাই, তোমার রাগের সাথেই সংসার থাকুক সারাজীবনের।

আচ্ছা, শুনলাম খাদিজা নাকি আবার চলে গিয়েছিলো রাগ করে? তুমি ওর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ওর বাবা মার হাত পা ধরে আবার নিয়ে এসেছো? হাহাহা….

একটা মানুষ কত অসহায় হলে এমনটা করতে পারে,জানো?

তোমার আরো অধঃপতন হবে। তোমার রাগ তোমাকে শেষ করে দিবে। মৃত্যুর সময় তোমার পাশে কেউ থাকবে না, কেউ না।

শেষ একটা প্রশ্ন, প্রশ্ন না ঠিক! তোমার কাছে জানতে চাওয়া,
বাড়ির কাজের মেয়েটাকে তুমি এই পর্যন্ত বিশবার অনুরোধ করে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে পারলেও আমাকে একবার অনুরোধ করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে না?

যাইহোক, আমার শরীরের কন্ডিশন ভালো না তেমন। মরে গেলে দেখতে এসো। আর শোন, আমার খুব ইচ্ছে, আমার কবরের উপর একটা শিউলি ফুলের গাছ থাকবে। কাউকে বলিনি এই ইচ্ছের কথাটা। তুমি আমার কবরের উপর একটা শিউলি ফুলের গাছ লাগিয়ে দিও কেমন?

ইতি,
নীলা (তোমার ডিভোর্স না দেওয়া বউ)।

আফজাল সাহেব চিঠি কুটিকুটি করে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন,

  • আমি ১০০ বার খাদিজাকে নিয়ে আসবো, তাতে তোর কি? রাগ করে চলে যাওয়ার সময় আমার কথা একবারও ভেবেছিলি? আর তোকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমার সদ্য প্রয়াত মা কয়বার গিয়েছিলো খেয়াল আছে তোর?

তুই তোর ইগো নিয়েই থাক। আমার কথা ভাবতে হবে না।

আফজাল সাহেব ব্যালকনিতে গিয়ে দাড়ালেন। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি। আফজাল সাহেবের যখন খুব কান্না করতে ইচ্ছে করে তখনি ঝুম বৃষ্টি নামে। কান্না আসার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না আফজাল সাহেব। চিঠিতে, নীলার অসুস্থতা, মৃত্যুর পরে তার প্রিয় শিউলি ফুল নীলার কবরের উপর রোপণ করে দেওয়ার কথা উল্লেখ করাতেই কি কান্না আসছে?

নীলা এই বাড়িতে নেই দীর্ঘ ২০ বছর যাবত। এমনি কোন এক ঝুম বৃষ্টির দিনে রাগ করে মেয়েটাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলো বাড়ি ছেড়ে।

আফজাল সাহেব নীলাকে ফিরিয়ে আনার কম চেষ্টা করেন নি। নিজের মা’কে বেশ কয়েকবার পাঠিয়েছেন নীলার কাছে। নিজেও কয়েকবার নীলাকে ফোন দিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বাড়ি ফিরে আসার কথা বলেছে।

আফজাল সাহেবের হঠাৎ বুক ব্যথা শুরু হলো। বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন। কয়েকবার খুব নরম কণ্ঠে, নীলা, নীলা বলে ডাকলেন। তারপর আর কোন সাড়া নেই।

বাসায় একসাথে ফিরেছে খাদিজা আর আফজাল সাহেবের মেয়ে নীলিমা। নীলিমা দৌড়ে আফজাল সাহেবের কাছে এসে হাউমাউ কান্না করে বললো,

  • বাবা, মা আর নেই। মৃত্যুর সময় তোমাকে অনেকবার দেখতে চেয়েছে। তুমি চলো মা’র কাছে।

আফজাল সাহেবের কোন সাড়া নেই। নীলিমা কয়েকবার আফজাল সাহেবকে জাগানোর চেষ্টা করলো। চিৎকার দিয়ে খাদিজাকে ডাকলো। খাদিজা এসেও আফজাল সাহেবকে কয়েকবার ডাকলো। এক পর্যায় নীলিমা বুঝতে পারলো ওর বাবাও আর নেই।

নীলিমার অনুরোধে বাবা মা’র কবর পাশাপাশি রাখা হলো। কয়েক বছর পর সেই জোড়া কবরের মাঝে একটি শিউলি ফুলের গাছ জন্ম নিলো। তারপর থেকে প্রতি বছর গাছটিতে দুইটি ফুল ফোঁটে। দুইটি ফুলের দূরত্ব অনেক হলেও ফুলগুলো ঝরে পড়ে একই সময়ে।

*সমাপ্ত*

লেখা: আসিফ হোসাইন (Asif Hossain)

Send private message to author
What’s your Reaction?
2
14
0
0
1
0
0
Asif Hossain
Written by
Asif Hossain
4.5 4 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
5 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Rubel Rana
Guest
Rubel Rana
2 years ago

সত্যি অনবদ্য লেগেছে। দিন কে দিন তোমার কলমের সৃষ্টিকল্প আমাকে মুগ্ধ করছে।এগিয়ে যাও ভাইটি❤️

2
Momin Hossain
Guest
Momin Hossain
2 years ago

দারুণ হইসে। এরকম লেখা অবিরত চাই।

shafiullah Oni
Member
shafiullah Oni
2 years ago

A very good story.

মো: মাইদুল সরকার
Member

ভালো লাগলো গল্পটি।++++

Mehruba Munira
Member
1 year ago

এখানে এসে প্রথমেই এই লেখাটা পড়লাম। সত্যিই খুব ভাল লিখেছেন।

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!