বন্দী

সাত সকালে আমিনুল ভাইয়ের কান্না শুনে ঘুম ভাঙলো। রাতে ভালো ঘুম হয় নাই। সারারাত বিনুর সাথে কথা বলেছি। বিনু আমার স্ত্রী। একটা স্মার্টফোন কেনার জন্য ৩ মাস আগে টাকা পাঠিয়েছিলাম। আজ কিনবো কাল কিনবো করে করে অবশেষে কিছুদিন আগে বিনু একটা ফোন কিনেছে। আমার চাচাতো ভাই পিন্টু, তার ভাবীর ফোনে আবার ‘ইমো’ও ইন্সটল করে দিয়েছে। কাল রাত ৪ টা পর্যন্ত কথা বলে ঘুমিয়েছি। তাও কথা শেষ হয়না!

কিভাবেই বা এত তাড়াতাড়ি কথা শেষ হয়!? বিয়ের ২৩ দিন পরই চলে এসেছি। আজ প্রায় দুই বছর হতে চললো দেশে যাই না….  কথা তো অনন্তকাল চলার কথা…

‘ও বিনু! কি করো?”
‘বসে আছি’
‘একটা ছবি দাও তো দেখি!’
‘ আর কত ছবি পাঠাবো?!”
‘ঘন্টায় ঘন্টায় আমাকে ছবি দিবা!”
‘ইশ! আমার আর কাজ নাই!?”
“আমি দেশে আসলে তোমাকে কোন কাজ করতে দিবো না। বলবো, বিনু তুমি আমার সামনে বসে থাকো আমি তোমাকে সারাদিন দেখি!’
‘হু, দুই বছর ধরে শুনছি আপনি আসবেন!” বিনুর খুব অভিমান!
‘আসবো তো! খুব তাড়াতাড়ি! “

কথা সত্য। আমি খুব তাড়াতাড়ি দেশে যাচ্ছি। কিছু টাকা জমেছে। আশা করি সামনের মাসে ফাইনাল হয়ে যাবে। ছুটির জন্য অলরেডি ম্যানেজার স্যারকে বলে রেখেছি। গত বছরও দেশে যেতে চেয়েছিলাম, পারি নাই। বললেই কি হয়?! এই কচকচে কাগজগুলো পেটের ক্ষুধা কমাতে পারে, মনের ক্ষুধা নয়! তবে এবার সত্যি দেশে যাবো। দেশে যাওয়ার পরিকল্পনাটা আমি বিনুকে বলিনি। বলবো না। বলা নাই, কওয়া নাই হুট করে যখন বিনু আমাকে দেখবে বিনু কি করে সেটা আমার খুব দেখার ইচ্ছা! এটা ভাবতেই আনন্দে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে!

সারাদিন কাজ করি। রাতে এসে যে রুমে কথা বলবো তাও হয়না। একরুমে আমরা পাঁচজন থাকি। ছোট ছোট পাঁচটা বেড, তিনটা টেবিল আর কাপড় রাখার জন্য রঙ,বেরঙ এর দড়ি! এই হলো আমাদের বেডরুম। আর পাশেই বারান্দা। বারান্দাটা আমরা কাপড় শুকানো আর রান্নার জন্য ব্যবহার করি। রান্না মানে কোনমতে খাওয়া এই আর কী!

আজকাল আমি প্রায়ই স্বপ্ন দেখি বিনু আর আমি দুজন নৌকায় করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বিনু হাত দিয়ে আমার দিকে পানি ছিটাচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে! সেই হাসির জন্য আমার সহস্র বছর বাঁচতে ইচ্ছা করে!
‘আচ্ছা বউ,তুমি আমাকে স্বপ্ন দেখো? ‘
‘হুম দেখি তো!’
“আমার চেহারা তোমার মনে আছে!’
“কী যে বলেন! থাকবে না কেন?!”
‘ বিনু! ‘
‘জি?’
‘ও বিনু’
‘শুনি তো?’
‘বিনু গোঅঅঅঅ!’
‘আস্তে কথা বলেন!”
‘বউকে ডাকি!”
“সবাই শুনে তো?’
‘শুনুক! প্রতিবেশির বউকে তো আর ডাকি না! নিজেরই বউ!”
বিনু হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়! ‘কী এক পাগলের সাথে বিয়ে হয়েছে!”

কথা শেষ না হতেই আমিনুল ভাইয়ের কন্ঠ ‘শহীদ ভাই! আর কত কথা বলবা? কথা বলতে বলতে তো শহীদই হয়ে গেলা! এবার ঘুমাও ভাই!’

‘জি ভাই ঘুমাচ্ছি।’

রাতে ফিসফিস করে কথা বলার শিল্পটা আমি এখনো রপ্ত করতে পারিনি। একটু পর পর আমিনুল ভাই বাথরুম যেতে ওঠেন। উনি এই রুমের সিনিয়র কিন্তু সবচেয়ে রসিক এবং আন্তরিক মানুষ।
আমি জিজ্ঞেস করি ‘কি হইছে ভাই?ঘুমান না?

‘এত প্রেমের কথা শুনলে ক্যমনে ঘুম আসে ভাই?’
আমিনুল ভাইয়ের সরল স্বীকারোক্তি! 
আমি লজ্জায় পরে যাই। আমার লজ্জায় চুপসে যাওয়া মুখ দেখে ভাই মজা পান!
‘না রে ভাই! আমি কিচ্ছু শুনি নাই” বলে হাহা করে হেসে দেন।
এই ভাই-ই আমাকে বিদেশ চিনিয়েছেন। থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বয়স বোঝা যায় না। হাসলে গালে টোল পরে। ওনার বড় মেয়ের কয়দিন আগেই বিয়ে দিলেন। কিন্তু বেচারা দেশে যেতে পারেন নাই। আমরা অবশ্য মানা করেছিলাম এত তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে  বিয়েটা না দিতে। কিন্তু মেয়ে বড় হয়েছে, এসএসসি পাশ করেছে, দেখতে সুন্দর, বাবা দেশে থাকেনা এত বড় মেয়েকে কে পাহারা দিবে?! তাই ভালো ঘরের প্রস্তাব পেয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলেন। মেয়ের বিয়ের দিন ভাই নিজ হাতে বিরিয়ানি রান্না করে আমাদের খাইয়েছেন।

গতরাতেও বিনুর সাথে কথা বলার সময়  আমিনুল ভাই আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গান গাইছিলেন ‘ও বিনু…..ও বিনু তুমি কোথায়….!’
এ যেন আমার ভিতরের আর্তনাদ!

আমিনুল ভাই কেঁদেই যাচ্ছেন। আমরা সবাই ঘিরে কেউ বাতাস করছি কেউ পানি দিচ্ছি।
‘ও ভাই!? বলবেন তো কি হইছে? ” রুমের একমাত্র ব্যচেলর মাসুদ উদ্বিগ্ন! যে মাসুদকে আমিনুল ভাই প্রায়ই উপদেশ দেন যদি শহীদের মতো বিয়া করিস তাহলে আর তোর বিয়া করা লাগবেনা। একলা থাকাই ভালো! নিজেও পুড়বি, বউটারেও পুড়াবি!

ভাইয়ের কান্নার কারন পাওয়া গেলো। সদ্য বিবাহিত কন্যাকে নাকি তার স্বামী মারধর করে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ যদি টাকা না পায় তাহলে আর মেয়েকে ঘরে নিবেনা। যদিও বিয়ের আগে টাকা পয়সা লেনদেন নিয়ে কোন কথাই হয়নি। কিন্তু বাবা বিদেশে থাকে ভালোবেসে মেয়েকে কিছু দিলে তো ক্ষতি নেই! ওটা কি তারা তাদের জন্য চেয়েছে নাকি! ওটা তো খুশি হয়ে দেওয়া!

যেখানে আমি বিনুর কাছে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি সেখানে আরেকজন টাকার জন্য গায়ে হাত তুলে নতুন বউকে দূরে ঠেলে দেয়?! বুঝিনা জগতের নির্মম নিয়ম!

ভাবী ফোনে জানিয়েছেন তিনি আর একা পারছেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাই যেন দেশে যান। নইলে মা-মেয়ে মিলে সুইসাইড করবে! কী সাংঘাতিক কথা! এই কথা শোনার পর কারোরই ঠিক থাকার কথা না! ‘আমি কি করি!? আমি কিভাবে দেশে যাই!?” ভাইয়ের বিলাপ! দুইমাস আগেই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, হাত পুরাই খালি। কার কাছে যাবেন তিনি? কি করবেন?!

‘বড়ভাই! মন ছোট করেন কেন!? আমরা আছি না? টাকার চিন্তা আপনি করবেন না। দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।  বাকীটা আমার উপর ছেড়ে দেন।’

‘ভাইরে! এটা সম্ভব না রে! তুমিও তো দেশে যাবা।”

‘ আপনার এখন বিপদ। ভাবী একা আর কত সামলাবেন, বলেন? দেশেও যান না অনেকদিন। কয়দিন থেকে সব সমাধান করে আসেন। আমার কথা ভাববেন না। ছোট ভাইয়ের জন্য অনেক করেছেন এবার বড় ভাইয়ের জন্য কিছু করার সুযোগ দেন…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই আমিনুল ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে আরো দ্বিগুণ শব্দ করে কাঁদা শুরু করলেন।
 
 
ঘটনার ৩ দিন পরই ভাই দেশে চলে গেলেন। রুমটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমাদের কারো ভালো লাগেনা। বিনুর সাথে কথা বলে যে একটু হালকা হবো তাও হচ্ছেনা। বিনুকেও পাচ্ছিনা। মা’র কাছে ফোন করার আগেই মায়ের ফোন।
‘শহীদ! ভাল আছে বাবা?’
‘জি মা, ভাল। আপনারা ভালো? বাবার শরীর এখন কেমন?’
‘এইতো আছে। ডাক্তার দেখায় কেবলই আসলাম। ডাক্তার সাহেব বলছে অপারেশন করতে।’
‘ও! কবে করতে বলছেন?’
‘যত তাড়াতাড়ি পারা যায়। তুমি খাইছ বাবা?’
‘ হ্যাঁ মা খাইছি’
‘কি খাইছ বাবা?”
‘কত কী! বিদেশে থাকি, বিদেশি খাবার মা!’
‘ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করো।’
‘বিনু ভালো আছে মা?’
‘ভালো৷ দাঁড়াও বিনুকে দেই” বলেই মা ‘বিনুউউউ…  ও বিনুউউ’ বলে ডাকতে ডাকতে উঠানে চলে এসেছেন।
আমি শুনতে  পাচ্ছি আমাদের উঠোনে মায়ের পালা হাঁস মুরগির ডাকে বাড়ী মুখর হয়ে আছে … চোখে ভেসে উঠছে পশ্চিমের তাল গাছগুলো বাতাসের সাথে সাথে দুলছে…. ঐ যে উওরের সেই লেবুগাছটি! লেবুর ঘ্রানে চারিদিক মৌমৌ করছে। আমরা বড় হওয়ার সাথে সাথে উঠোনটি যেন ছোট হয়ে গেছে। কত খেলা খেলেছি এই উঠোনে…. বড় আপার বিয়ের সময় লাল-নীল কাগজ কেঁটে সাজিয়েছিলাম। তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। কী সুন্দর শৈশব ছিল আমাদের….!

‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম “- বিনুর কন্ঠ!

‘বিনু! ভালো আছ তুমি?
‘জি আপনি ভাল?’
‘ভাল আছি। তোমার ফোন কি হইছে?’
বিনু চুপ।
‘কি হলো?’
“পানিতে পড়ে গেছে!”
“কিভাবে?”
“পুকুরে থালা বাসন ধুইতে গেছিলাম, হঠাৎ পানিতে পড়ে গেছে!”
“ওহ! আমাকে একটু জানাবে না? আমি কত টেনশন করছি!”
“নিজের উপর নিজের রাগ হচ্ছে! আপনাকে জানাতে ভয় হচ্ছিল! নতুন ফোন একমাসও হয়নি…!”
‘ এটা নিয়ে চিন্তা করো না। তুমি আবার পানিতে পড়ে  যাও নাই তো!?’
“পড়ে গেলে ভালোই হতো আপনি বেঁচে যেতেন…!” বলেই বিনুর হাসি শুরু।  কিন্তু আজকে বিনুর হাসি শুনে আমার বুক ভারী হয়ে আসে… তোমাকে পেয়েও এখন মনে হয় খুব বেঁচে আছি বিনু!!? আর কথা বলতে ভালো লাগছিল না–
‘বিনু, মা কে দাও তো?
‘দাঁড়ান, দিচ্ছি!’

বাবার অপারেশনের জন্য বাড়িতে টাকা পাঠালাম। বিনুকেও বললাম আরেকটা ফোন কিনে নিতে…  আবার  টাকা জমানো শুরু করতে হবে…  ইদানীং মনটা একটুতেই খারাপ হয়। ঘুমালেই স্বপ্ন দেখি আমি দেশে গেছি। বিনু আর আমি নৌকায় ঘুরছি, আমাদের ছেলেমেয়েও সাথে! এই স্বপ্ন কবে সত্যি হবে জানিনা। বিনু! একবার তোমার কাছে গেলে, ফিরবো না আর এই টাকার শহরে, কথা দিলাম! সুখে-দুঃখে একসাথে তোমার সাথে থাকতে চাই, তোমার হাসি ছুঁয়ে দেখতে চাই, যে হাসির জন্য সহস্র বছর আমার বাঁচতে ইচ্ছা করে!

খাদিজা তুল কোবরা কাব্য (khadiza tul kobra kabbyo)

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
2
0
0
0
0
0
Khadiza tul kobra kabbyo
Written by
Khadiza tul kobra kabbyo
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shibli Sayeek
Member
2 years ago

গল্প রচয়িত্রী একজন নারী হয়েও ছেলেদের হৃদয়ের বেদনাকাতর অনুভূতি এত সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন, এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।

কেউ যখন বিদেশে যায়, তখন সে এমনই শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পড়ে। গল্পে এই দিকটি চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

1
Last edited 2 years ago by Shibli Sayeek

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!