জোবেদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “খালাম্মা আপনারা বড়লোক মানুষ। ইমিটেশন পড়লেও মানুষ স্বর্ন বলবে আর আমরা গরীবেরা স্বর্ন পড়লেও সবাই ভাবে ইমিটেশনের।”
জোবেদা বেগমের কথাগুলো সত্য। নিশি গলায় যে সোনালী রঙের চেইনটা পড়ে আছে সেটা কালই নিউ মার্কেট থেকে ২৫০ টাকা দিয়ে কিনেছে। আজ হঠাৎ জোবেদার চোখে পড়েছে
‘খালাম্মা নতুন ছেন?”
“হ্যাঁ ‘
‘সুন্দর হইছে! কত দিয়া বানাইলেন?”
নিশি সেই কথা কানে নেয় না।
“জোবেদা খালা আজ তাড়াতাড়ি কাজ করতে হবে। বাইরে যাব আমরা।”
” খালাম্মা, ছেনটা কি খালু সাহেব গিফট করিলেন?”
” খালা, সময় নাই কিন্তু। আজকে এমনি দেরী করে এসেছেন।”
“করতাছি তো! বইসা আছি নাকি!? খালা আজকে আমারে কিছু টাকা দেওন লাগবো” জোবেদার কথায় খুব তেজ।
“কিসের টাকা?”
“আমার খালি প্যাট কামড়ায়। প্যাটে কম্পিউটার করন লাগব”
“কি বলেন? বুঝলাম না তো?”
“প্যাটের মধ্যে মেশিন দিয়া দেখেনা? সেইটা করবে।”
“ও আচ্ছা!”আজকে তো পারবো না খালা। আমার কাছে টাকা নাই। কাল নিয়েন।”
নিশি খুব ভালোভাবে জানে জোবেদার কিছু হয় নাই। গলায় চেইন দেখে তার টাকা নেওয়ার চিন্তা। বাসায় নিত্য নতুন জিনিস দেখলেই তার পেট ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, মোবাইল নষ্ট ইত্যাদি ইতিহাস শুরু হয়ে যায়। ভাবখানা এমন নতুন জিনিস কিনছো ট্যাক্স দাও!
“আচ্ছা, মনে কইরা দিয়েন। এপার্টমেন্ট দিয়া রাখছি” বলে কাপড় ধুতে যায় জোবেদা বেগম।
জোবেদা এই বাসায় ২ মাস হল কাজ করছে। তার স্বামী আরেক জায়গায় বিয়ে করেছে । দুই মেয়ে ১ ছেলে নিয়েই জোবেদার সংসার। জোবেদাকে আমার শ্বাশুড়ি প্রথম দেখে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেছিলেন –
” বৌমা! এত বড়সড় কাজের লোক রাখছো কেন? কাজের লোক সবসময় ছোটখাটো রাখতে হয়, যেনো তোমারে ধরলে তুমিও কয়টা কিল ঘুষি লাগায় দিতে পারো!”
- “আম্মা কাজের লোক আমাকে ধরবে ক্যান?”
- “ঢাকা শহরে এখন তো এগুলাই হয়। কাজের নামে ডাকাতি করে।”
- “না মা, মহিলাটা ভালো আছে।”
“তারপরও ভয় লাগে। সাবধানে থাকবা”
আমার শ্বাশুড়ির কথা শোনার পর থেকে জোবেদাকে আরো বেশি ডেয়ারিং মনে হয়। প্রতিদিনই তার একটা না একটা বাহানা। সন্দেহ বাড়ে।
২)
নিশি রেডি হচ্ছে। বেগুনি রঙের জামদানী শাড়ীর সাথে নিউমার্কেট থেকে কেনা ২৫০ টাকার সেই চেইন আর ৪০০ টাকার দুটো চুড়িই তার অর্নামেন্টস। আর কানে মার দেওয়া সোনার ছোট্ট কানের দুল। এই দুলটা নিশির মেয়ে হওয়ার পর মা আদর করে মেয়েকে বানিয়ে দিয়েছে। সোনা বলতে শুধু এই দুলটাই নিশির সম্বল। অফিসের প্রোগ্রামে যাবে পরার মতো কোন জিনিস নেই। সেই প্রোগ্রামে বড় বড় বসরা আসবেন, বসের ওয়াইফরা থাকবেন একটু তো সাজগোছ করতেই হয়। শাহান নিজে থেকে নিশিকে বলেছে কিছু ইমিটেশনের অর্নামেন্টস কিনতে। প্রেস্টিজ বলে কথা! একটুপর শাহান অফিস থেকে ফিরবে। তারপর ফ্রেশ হয়ে দুজন অফিসের প্রোগ্রামে রওনা দিবে।
৩)
শুক্রবার। শাহান মসজিদে জুম্মার নামাজে আর নিশি রান্নাঘরে। জোবেদাকে তার পেট ‘কম্পিউটার’ করার জন্য টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি খুশি নন। হয়তো আরো বেশি কিছু আশা করেছিল। এইজন্য রাগ দেখিয়ে জিনিসপত্র ছুড়ে ছুড়ে শব্দ করে কাজ করছে। ‘কিছুই বুঝতে পারছেনা’ এমন ভান করে নিশি রান্না করেই যাচ্ছে।
“আপনার খালু আসার আগে তাড়াতাড়ি বেডরুমগুলো মুছে ফেলেন।”
জোবেদার শব্দ আরো বেড়ে যায়। এত রাগ! নিশির মুখের দিকে ফিরেও তাকায় না।
“এই যে খালা শুনছেন? তাড়াতাড়ি করেন!”
” কাজ করতেছি দ্যাখেন না?”
“আর আপনাকে না বলছি মাস্ক পড়ে আসবেন? আপনার মাস্ক কই?”
” গরীবের করোনা হয়না, এগুলা বড়লোকগো ওসুখ” মুখের উপর জবাব দিয়ে ঘর মুছতে যায়।
এরই মধ্যে শাহান চলে এসেছে। নিশি টেবিলে খাবার দিচ্ছে। হঠাৎ শাহানের চিৎকার
“এই যে! কি করেন?! আপনার এত বড় সাহস?!!!”
নিশি দৌড়ে বেডরুমে যায়। কাল রাতে পার্টি থেকে এসে ড্রেসিং টেবিলের উপর যে গলার চেইন আর চুড়ি খুলে রেখেছিল জোবেদা বেগম আশেপাশে কাউকে না দেখে শাড়ির আচঁলে বেধে নিতে যেয়েই শাহান দেখে ফেলেছে!
” আপনাকে আমি পুলিশে দিবো!” শাহানের চিৎকার!
“তুমি চুপ থাক আমি দেখছি”
জোবেদা এতক্ষণ নিশির সাথে যে তেজ ও জেদ দেখাচ্ছিল শাহানের চিৎকারে এখন তার হাত পা কাঁপছে
“খালু গো মাফ কইরা দ্যান!”
“আমার আম্মা ঠিকই বলছিল, তখন তো শোন নাই!!’ এবার নিশির দিকে লক্ষ্য করে শাহানের হুংকার!
“আহা বাদ দাও তো! এগুলো তো ইমিটেশনের! “
“ইমিটেশন হোক আর সোনা হোক-চুরি তো চুরি-ই!” খুব নীতিবান শাহান!
“স্যার! স্যার! খালাম্মা! আমারে বাঁচান! পুলিশ ডাইকেন না। গরীব মানুষ গো খালা!”
জোবেদা, নিশির পা ধরে শব্দ করে কেঁদে দেয়
“আপনার পা ধরি খালাম্মা, মাফ কইরা দেন!”
শাহান পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা হাতে নেয় কাউকে কল করতে। নিশি সাথে সাথে শাহানের হাত থেকে ফোনট কেড়ে নেয় “কী পাগলামি করছো?!”
“ও চোর! ওকে পুলিশে দেওয়া উচিৎ নিশি! “
জোবেদা বেগম কে কিছু টাকা দিয়ে নিশি বিদায় দেয়। আর কোনদিন যেন এদিকে না আসে।
৪)
নিশি এবং শাহান দুজন বিছানার দুইপ্রান্তে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। শাহান এখনো রেগে আছে নিশির জন্য জোবেদাকে পুলিশে দিতে পারেনি। নিশি অবশ্য সে চচিন্তা করছেনা। সে অন্য এক দুনিয়ায় অন্য কিছু নিয়ে ভাবছে…. শাহান অপেক্ষা করছে নিশি কিছু বলবে। অবশেষে নিজেই বলা শুরু করলো
‘ নিশি! আজকে জোবেদাকে মানবতা দেখিয়ে মাফ করে দিলে, কাল যখন আরেক বাসায় কাজ করতে আবার চুরি করবে, তখন? এট লিস্ট পুলিশে দিলে একটা শিক্ষা হতো!”
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর নিশি আস্তে আস্তে বলে “জোবেদা তো আমার হেল্পিং হ্যান্ড। সে গরীব মানুষ। তার কাছে আমার কোন আশা নেই, দাবী নেই৷ সামান্য ইমিটেশনের গয়না চুরির জন্য, চোর’ বলে, তুমি তাকে পুলিশে দিতে চাও! আর যে স্বামী, স্ত্রীকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে তার সব গহনা বিক্রি করে ব্যবসার কাজে লাগায় তাকে তুমি কি বলবে!?”
…..আর কারো কোন কথা নেই । শুধুই নীরবতা … কী এক শূন্যতায় হাহাকার করে ওঠে চারিদিক… আজ বাতাস নেই, চাঁদের আলোও নেই .. চাঁদও চায়না নিশির এই ভেজা বালিশটা আর কেউ দেখুক….
Send private message to author