টঙয়ের এই দোকানটায় বসে নীল প্রায় প্রতিদিনই লক্ষ্য করে মেয়েটাকে। মেয়েটা কখনো অন্য সব মেয়েদের সাথে দল বেঁধে যায়, আবার কখনো সাথে থাকে মাত্র দুই একজন তারই সমবয়সীর মেয়ে। কখনো কখনো আবার সাথে কেউই থাকে না। মাথা নিচু করে একা একাই হেঁটে যায়। নীল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না মেয়েটা রাস্তা ছেড়ে গলিতে না ঢুকে যায়। জ্বলন্ত সিগারেটে আর টান দেওয়া হয় না। আপনা-আপনিই পুড়ে যায়। মাঝে মাঝে সেটা পুড়ে হাতে দুই একবার ছ্যাঁকা যে দেয় নি তেমনটা নয়। হাতে আঁচ লাগলে হুশে ফিরে নীল।
.
বলতে দ্বিধা নেই যে মেয়েটাকে খুব ভালো লেগেছে ওর। কিন্তু বলার সাহস হয় নি। তাছাড়া হুটহাট করে রাস্তায় কোনো যুবতী মেয়েকে দাঁড় করিয়ে কথা বলাটাও তো ভদ্র ঘরের ছেলের শোভা পায় না। মেয়েটা খুব সম্ভবত এই মহল্লায় নতুন এসেছে। কারণ একমাস আগেও এই মেয়েকে এই পথ দিয়ে যেতে দেখে নি সে। দিনের প্রায় বেশির ভাগ সময়ই তো এখানে কাটে ওর। সে যদি নতুনই না আসতো তাহলে নিশ্চই আগেও দেখা হতো। কলেজ ইউনিফর্ম দেখে বুঝতে বাকি থাকে না যে মেয়েটা এখানকার কলেজেই পড়ছে । বোধহয় অনার্সে কিন্তু কোন বর্ষে সেটা আন্দাজ করা শক্ত। কারণ আজকাল মেয়েদের বয়স বোঝার উপায় নেই, আর তাছাড়াও বয়সের সাথে লেখাপড়ার কোনোই সম্পর্ক থাকে না। কতই তো আছে এমন যে বয়স বেশি কিন্তু যে কারণেই হোক লেখাপড়ায় খুব একটা এগিয়ে যেতে পারে নি। আবার এমনটাও হয় যে কম বয়সেই বেশি ক্লাসে চলে যায়। নীলের অবশ্য এইসব নিয়ে কোনোই ভাবনা আর মাথা ব্যথা কোনোটিই নেই। কেবল সকালে আর বিকেলে এইটুকু সময়ের দেখাতেই ওর মনটা ভরে উঠে ভালো লাগায়। তাতে যদি একদিনও ছেদ পড়ে তাহলেই ছটফট করে কোনো এক তাড়নায়। এটাকে ভালোবাসা ছাড়া আর কিইবা বলা যেতে পারে? প্রেম? হুম প্রথম প্রথম সেটাও বলা যেতে পারে। কারণ কারও প্রতি যদি প্রেমই সৃষ্টি না হলো তাহলে ভালোবাসা জন্মাবে কোথা থেকে?
.
নীল যে কেবল এই টঙয়ের দোকানের বেঞ্চটায় বসে বসেই মেয়েটা লক্ষ্য করেছে তেমনটা কিন্তু নয়। এমনও দিন গেছে যে সেও বাইক নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেটা দুই একবার। তবে পিছু পিছু যাওয়ার সাহস হয় নি, হুট করেই যদি মেয়েটা ঘুরে প্রশ্ন করে তার পিছু পিছু আসার কারণ কী তাহলে নীল কী জবাব দিবে? বলবে যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই পিছু নিয়েছি? কিংবা বলবে যে তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে তাই……। কিন্তু ঘুরে ফিরে তো একই বিষয় দাঁড়ালো। এতে মেয়েটা যদি কিছু না বলে তাহলে তো কোনো চিন্তায় রইলো না। কিন্তু যদি তেমনটা না হয়? তাহলে তো লোকজন জড়ো হবে, নানান কেলেঙ্কারী। কথাটা ওর বাবার কান অব্দি পৌঁছাতে খুব বেশি দেরি হবে না হয়তো। যদিও নীল মানুষটাকে একেবারেও পছন্দ করে না, বাবাও হয়তো কিছু বলবে না। কিন্তু তবুও তার ছেলে রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্যক্ত করছে কথাটা শুনলে মা নিশ্চই খুবই কষ্ট পাবে। এইসব সাত পাঁচ ভেবে কিছু করতে পারে না নীল। কেবল দেখে আর ভাবে জীবন এত জটিল কেন।
.
নীলের যখন ১২ বছর বয়স তখন ওর বাবা একটা দুর্ঘটনায় মারা যান। যদিও অভাব ছিলো না কিছুরই তবুও, সবার এক প্রকার জোড়াজুড়িতেই ২য় বিয়েতে মত দিতে হয়েছিলো ওর মাকে। সবার মুখেই একই কথা, জীবনের বেশি ভাগ সময়টাই তো বাকি পড়ে আছে, হ্যানত্যান। কিন্তু মায়ের এমন সিদ্ধান্তে যদি কেউ অখুশি হয় তাহলে সেটা একমাত্র নীল নিজেই। নতুন এই বাবাকে মোটেও আপন করে নিতে পারেনি ও। তবে মানুষটা কিন্তু ভালোই। নীলকে নিজের ছেলের মতন নয় বরং নিজের ছেলেই জেনে এসেছে এতোদিন। ভবিষ্যতেও যে তার অন্যথা হবে না সেটাও বোঝা যায়। কিন্তু তবুও কেন জানি নীলের দম বন্ধ হয়ে আসে। কত বার ভেবেছে যে সব ছেড়ে একদিন চলে যাবে অনেক দূর। কিন্তু পারে না একমাত্র মায়ের জন্য। নীল বোঝে তিনিও ছেলের এমন পরিবর্তনে বেশ অনুতপ্ত। কত বারই তো ভেবেছে যে যা হবার তা তো হয়েছেই সবাই তো কত খুশি, সে কেন পারবে না মেনে নিতে। কিন্তু নাহ্ পারে নি নীল।
.
নীল আজও মেয়েটাকে দেখলো। আজ অবশ্য সাথে কেউই নেই, একাই হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটা। নীল একবার আশেপাশে তাকালো। নাহ্ কাছে পিঠে কাউকেই চোখে পড়লো না। একবার কী গিয়ে কথা বলবে মেয়েটার সাথে? হাজার হলেও মহল্লায় নতুন এসেছে, দুই একটা কথা তো বলাই যায়। কিন্তু…….
ভাবতে ভাবতে টঙয়ের দোকানটার সামনে চলে আসে মেয়েটা। বুকের হৃদযন্ত্রটা যেন আরও দ্রুত কাজ করা শুরু করে। মনে বেশ কিছুটা সাহস আনে নীল। হাতের আধপোড়া সিগারেটটা পায়ের তলে পিষ্ট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে এরই মধ্যে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। শরীরের সব টুকু শক্তি গলার মাঝ বরাবর এনে ডাক দেয় মেয়েটিকে নীল,

  • এই যে শুনছেন?
    .
    কথাটা শুনেই পিছন ফিরে তাকালো মেয়েটি। দেখলো একটা ছেলে এগিয়ে আসছে ওরই দিকে। আশপাশটা একবার দেখে নিলো মেয়েটা। নাহ্ কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা একটু হাসি মুখেই বললো,
  • জ্বি আমাকে বলছেন?
    ততক্ষণে নীল বেশ কিছুটা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির। পা কাঁপছে, বুকটা ধুকধুক করছে। হৃদযন্ত্র এত জোরে পাম্প করছে যে মনে হচ্ছে এখনই বোধহয় বুকের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসবে ছিঁটকে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারে না নীল। গলাটা যেন শুকিয়ে আসছে। সব কথাগুলো যেন জমাট বাঁধছে গলার ঠিক মাঝ বরাবর। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে নীল। তারপর ধরাধরা কণ্ঠে বলে,
  • দেখুন ভয় পাবেন না, আমি নীল। এই মহল্লাতেই থাকি। আপনাকে আগে কখনো দেখি নি, এক মাস যাবত দেখছি। আপনি কী নতুন এসেছেন এখানে?
    .
    এই সামান্য কথাগুলো বলতে বলতেই বেশ খানিকটা হাঁপিয়ে উঠে নীল। বুঝতে পারে কোনো অপরিচিত মেয়ের সাথে কথা বলাটা খুব একটা সহজ কাজ নয়। এতে শক্তি আর সাহস দুইয়ের প্রয়োজন। কিন্তু আশ্চর্য এই যে মেয়েটার কিন্তু কোনো ভাব গতি বোঝা গেলো না। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
  • জ্বী আমরা এখানে নতুন এসেছি। একমাস আগেই বাবার বদলী হয়েছে এই থানায়। ঐ যে গলিটা দেখছেন তার দুই বাসা পরেই আমাদের বাসা।
    .
    হাতের ইশারায় গলিটা দেখিয়ে দেয় মেয়েটা। নীল যদিও জানে তবুও একবার তাকায় সেদিকে। তারপর বলে,
  • ও আপনার বাবা বোধহয় পুলিশের কর্মকর্তা? বেশ তো।
  • হ্যাঁ, এই থানার যে একজন নতুন ওসি এসেছেন, তিনিই আমার বাবা।
  • আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যান। দেখুন কিছু মনে করবেন না। নিছক কৌতুহল বশত জানতে চাইলাম আরকি।
    .
    নীলের এ কথা শুনে মেয়েটা একটু হাসে। নীল দেখলো মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দর হলেও তার আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে ঐ হাসিতে। আর হাসলে যে গালের একটু খানি টোলের মতো গর্তের সৃষ্টি হয়, তাতেও সৌন্দর্য বেড়ে যায় কয়েকগুন। ইচ্ছে ছিলো আরও কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকতে, কিন্তু দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় সে। মেয়েটা বললো,
  • হুম,আপনি মনে হয় ভয় পাচ্ছেন তাই না? আমার বাবা পুলিশ তাই? কেন পুলিশের মেয়ের সাথে বুঝি কথা বলা অপরাধ?
    .
    নীল আর কোনো কথা বলে না। দ্রুত চলে আসে টঙয়ের দোকানটায়। আর কিছুটা সময় থাকলে হয়তো নিজেকে সামলানো বেশ মুশকিল হয়ে যেত। বেঞ্চটায় বসে হাঁপাতে থাকে সে। তারপর দোকান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে আগুন দেয় তাতে। পর পর বেশ কয়েকটা টান দেওয়ার পর অনেকটাই স্বাভাবিক মনে হয় নিজেকে। তারপর আবার তাকালো রাস্তার দিকে। মেয়েটাকে কিন্তু আর দেখা গেলো না। বোধহয় গলির ভেতরে ঢুকে গেছে।
    .
    রাত আনুমানিক বারোটা। ঘরের আলোটা বন্ধ করে বিছানার এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসছে না নাঈমার। বুকের ধকধকানিটা যেন এখনো কমতেই চাইছে না। বিকেলের ঐ অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা জেগে তুলছে বার বার। চোখের পাতা একটু বন্ধ করলেই বিকেলের ঐ ছেলেটার ভয় মাখা চেহারাটা ভেসে উঠছে বার বার। নাঈমা ভেবে পায় না যে সে সময় নিজেকে কীভাবে এতটা সামলে ছিলো। ছেলেটা বুঝে ফেলে নি তো তার দূর্বলতা? নাহ বোধহয় সেটা ওর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ইশ যদি বুঝতো তাহলে কি যে লজ্জায় পড়তো তখন। ভাবতেই মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠে নাঈমার। ভাগ্যিস ছেলেটা তখন তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিলো। আর তাই তো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে গলির পথটায় ঢুকে পড়তে পেরেছিলো। কোনো মতে গলির মুখটায় ঢুকেই যে সে হাঁপাতে শুরু করেছিলো সেটা কী ছেলেটা জানে? হয়তো জানে না। সে যদি আর একটু থাকতো সামনে দাঁড়িয়ে, তাহলে না জানি কী করে বসতো নাঈমা। হয়তো গড়গড় করে বলেই ফেলতো সব কথা। ভাবতে ভাবতেই ফর্সা গালটা লাল হয়ে উঠে নাঈমার। সুইচ টিপে আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে আয়নায় সামনে একবার দাঁড়ায়। ইশ নিজের এই লজ্জা মাখা চেহারা দেখে নিজেই তো আরও বেশি লজ্জা পাচ্ছে। ছেলেটা নিশ্চই……। আর ভাবতে পারে না নাঈমা। মুখটা দুই হাতে ঢেকে ফেলে। কী যেন বললো ছেলেটার নাম? নীল? হুমম নীলই তো।
    .
    ছেলেটাকে নাঈমা প্রথম দেখেছিলো ওদের ক্যাম্পাসে, বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময়। আর একবার দেখাতেই ছেলেটাকে বেশ মনে ধরে ওর। যাকে বলে লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট। দ্বিতীয় বার দেখেছিলো টঙয়ের ঐ দোকানটায়। তারপর প্রতিদিনই একবার আসার সময় আরেকবার যাওয়ার সময় আড় চোখে একটু খানিক জন্য তাকিয়ে দেখতো খুব সাবধানে। কেউ একটু খানি বুঝতে পারলেও লজ্জার সীমা থাকবে না। এর মধ্যেই দুই একদিন ছেলেটা বাইক নিয়ে সামনে দিয়ে চলে গিয়েছিলো। আর তখন অনেক কষ্টে নিজের চোখ কে সামলে নিয়েছিলো ও। তবে ছেলেটা যে ওকে একবারের জন্য দেখেছিলো সেটা আড় চোখে তাকিয়ে বুঝতে দেরি হয় নি নাঈমার। কিন্তু তা দেখুক, তাই বলে তো আর সেও নিলর্জ্জের মত তাকিয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু আজ যখন নীল ওকে ডাকলো তখন বুকটা একবারের জন্য হলেও কেঁপে উঠেছিলো। যদিও সে প্রতিদিনই ঐ টঙয়ের দোকানের সামনে আসার আগে থেকেই নিজেকে বেশ খানিকটা প্রস্তুত করেই আসতো। তবুও সে চেষ্টায় গুড়ে বালি। দোকানটার সামনে আসলেই বুকের ধক ধক শব্দটা আরও বেড়েই চলে। প্রতিদিনই ওর মনে হয় এই বুঝি ছেলেটা ডাকবে পিছন থেকে। কিন্তু তা ডাকে না। কিন্তু আজ যখন ডাকলো তখন উল্টো মুখে একবার হেসেছিলো মুখ টিপে, তারপর নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়েছিলো নাঈমা।
    .
    নানান কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে নাঈমা। কিন্তু বিকেলের ঐ ঘটনাটা দিনের আলো ভেদ করে চলে গেলো ঘুমের মাঝেও। সে স্বপ্ন দেখলো, পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। কখনো কখনো নিজেদের অনিচ্ছাতেই ছুঁয়ে যাচ্ছে একে অপরের হাতে। আর সেই অল্প ছোঁয়াতেই কেঁপে কেঁপে উঠছে নাঈমা। হঠাৎ করেই একটা দ্রুত গামি বাইক এসে একেবারে তাদের গা ঘেঁষে চলে গেলো। নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিলো সে। কিন্তু না, পড়তে হলো না। তার আগেই ধরে ফেললো নীল। আর আবদ্ধ করলো নিজের বাহু ডোরে। আবেশে চোখটা বু্জে আসে ওর, আর পরক্ষণেই টের পেলো একজোড়া ঠোঁট এসে ছুঁয়েছে ওর কোমল ঠোঁট। আর তারপর……..।
    .
    না তারপরের দৃশ্য আর দেখা হলো না নাঈমার, তার আগেই বেরসিক ঘুমটা ভেঙে গেলো। চোখটা খুলেই নিজেকে আবিষ্কার করলো নিজের বিছানাতে। স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই নিজের ঠোঁট দাঁতে চেপে ধরে। ইশ কী লজ্জার স্বপ্নটাই না সে দেখলো। ঘুম ঘুম চোখে দেয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকায় নাঈমা। আর তাকাতেই দেখলো নয়টা বেজে গেছে। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়ে সে। ইশ রে আজ বড্ড দেরি হয়ে গেলো। প্রথম ক্লাসটা মিস তো হবেই তার সাথে আরও কত কি মিস হবে।
    .
    ঐ দিকে নীলের অবস্থাও বেশ কাহিল। রাতে একটুও ঘুম হয়নি। চোখের পাতা এক করতেই পারেনি একটা বারের জন্যও । বার বার মেয়েটার হাসি মাখা মুখ খানা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। এইসবের মাঝেও আরও একটা ঘটনা ঘটেছে ওর জীবনে। সাধারণ অনেক রাত করেই ঘুমায় নীল। আর যতটুকু সময় সে জেগে থাকে ততক্ষণ ছাদেই পায়চারী করে। গত রাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একটা সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করছিলো আর ভাবছিলো বিকেলের কথাগুলো। নিজের অমন কাণ্ডে মাঝে মাঝে বেশ হাসিই পাচ্ছিলো ওর। নিজের ভাবনাতে এতটাই মগ্ন ছিলো না বুঝতেই পারে নি কখন তারই পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে আরেকটা ছায়ামূর্তি। জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে পুরো ছাদ। ছেলেকে এত খুশি এর আগে কখনো দেখেননি ভদ্রলোক। ছেলের এমন খুশিতে বাধা হতে চান নি তিনি। ফিরেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু যেতেই অসাবধানতায় পায়ের একটা শব্দে পিছন ফিরে তাকালো নীল। বাবা দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। যদিও তিনি জানেন সবটাই তবুও বাবার সামনে সিগারেট খাওয়া মোটেও ভদ্র ছেলের কাজ হবে না ভেবে একটু তড়িঘড়ি করেই ফেলে দিলো সিগারেটটা।
    .
  • কি রে ফেলে দিলি যে? আমি কিছু মনে করি নি কিন্তু।
    .
    নীল এই এত বছরে এই প্রথম বোধহয় মানুষটার দিকে তাকালো ভালো করে। চাঁদের আলোয় হাসি মাখা মুখ খানা জ্বলজ্বল করছে মানুষটার।
  • নাহ্ এমনিতেই।
  • তোকে আজ খুব খুশি মনে হচ্ছে। আমি থাকলে তাতে বাধা হতে পারি বলে চলে যাচ্ছিলাম।
    .
    লোকটার এমন বিনয়ী কণ্ঠে মনটা বেশ খারাপই হয়ে যায় নীলের। সবাই লোকটাকে খুবই ভালোবাসে, কেবল নীল বাদে। আজ কেন জানি নিজেকেই বেশ অপরাধী মনে হচ্ছে। তাছাড়া লোকটা তো কোনো অপরাধ করে নি। তার মাকে বিয়ে করেছে বলেই কী তিনি নীলের কাছে এত অবহেলিত? নীল জানে, লোকটা তাকে কতটা ভালোবাসে। যদি তাই না হতো তাহলে কী সব জেনেও এতটা দরদ দিয়ে কথা বলা যায়? নীল বললো,
  • তুমিও থাকো না।
    ভদ্রলোক যে ঠিক কত টা খুশি হলো সেটা বাইরে থেকে বোঝা গেলো না ঠিকই কিন্তু তবুও তার কিছুটা রেশ তার কণ্ঠে প্রকাশ পেলো। বললেন,
  • আচ্ছা বেশ থাকবো।
    .
    বেশ কিছুক্ষন কারও মুখের কোনো কথা নেই। নীরবতা বাবাই ভাঙলেন। বললেন,
  • দেখ আমি জানি তুই আমাকে পছন্দ করিস না। তবুও বাবা হিসাবে না হোক, বন্ধু হিসাবে বলতে পারিস কিন্তু। আসলে হয়েছে কী জানিস, তোকে এতটা খুশি আমি এর আগে কখনো দেখি নি তো, তাই তোর এই খুশির কারণটা জানার লোভ সামলাতে পারছি না। তবে তুই যদি আমাকে না বলতে চাস তাহলে বলিস না। সত্যি বলতে কী তোকে খুশি দেখলে খুব ভালো লাগে জানিস তো।
    .
    শেষের কথাগুলো বলতে বলতে বাবার গলাটা খানিক কেঁপেই উঠলো। নীল বললো,
  • তেমনটা নয় বাবা।
    .
    ভদ্রলোক যেন একটু চমকেই উঠলেন। এত বছর পর নীল যে তাকে বাবা বলে ডাকছে তা যেন বিশ্বাসই হতে চায় না। তবুও তিনি ঠিকই শুনেছেন, বাবা বলে ডেকেছে। নিজেকে খানিকটা সামলে নেয় ভদ্রলোক। তারপর বলে,
  • তাহলে বল আমাকে।
    .
    নীল আর দ্বিধা করে না। সবটাই খুলে বলে স্ব-বিস্তারে। সবটা শুনে ভদ্রলোকের খুশি যেন আর ধরে না। বেশ উত্তেজিত হয়েই বলে,
  • সে কী রে? নাম কী মেয়েটার বল আমাকে।
  • জানি না আমি। শোনা হয় নি তো।
  • দেখ তো কী গাধার মত একটা কাজ করেছিস। আরে বাবা নামটা তো শুনবি তাই না? শোন কাল সকালে আমাকে নিয়ে যাবি তো?
  • সত্যি বলছো? যাবে তুমি?
  • যাবো না মানে? অবশ্যই যাবো।
    .
    নীল জড়িয়ে ধরে বাবাকে। আবেগে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলেন ভদ্রলোক। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেয় নিজেকে।
    .
    প্রতিদিনের মত আজও টঙয়ের দোকানটায় এসে বসেছে নীল। তবে আজ আর একা নয়, সাথে বাবাও আছে। ওরা এসেছে মিনিট দশ হলো, কিন্তু এরই মধ্যে বাবা বেশ কয়েকবার প্রশ্ন করেছে,
  • কী রে, কোথায় মেয়েটা? এখনো আসছে না যে।
    .
    নীল অবশ্য এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় নি। অবশেষে আসলো মেয়েটা। নীল চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো বাবাকে।
  • যা, কথা বলে আয়।
    কথাটা শুনে একবার আমতা আমতা করে তাকায় নীল। তারপর হাঁটা শুরু করে। নাঈমাও ততক্ষণে হাঁটার গতিটা বেশ খানিকটা কমিয়ে দিয়েছে। নীল যখন ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো তখন নাঈমা মাথাটা খানিক নিচু করেই দাঁড়িয়ে ছিলো। বেশ কিছুক্ষণ কারও মুখেও কোনো কথা নেই। অবশেষে নাঈমা মাথা নিচু করে এক নিঃশ্বাসে বললো,
  • দেখুন এটা কিন্তু একদমই ঠিক না, আমি সবই দেখি। আমি এমনিতেও নিজেকে সামলে রাখতে পারি না। তার উপর আপনি এমন লুকোচুরি করছেন। আমাকেই কেন বলতে হবে সবটা? আপনি তো ছেলে আপনিই বলুন না। আমি পারবো না বলতে যে আমি আপনাকে ভালোবাসি। এটাও বলতে পারবো না যে কাল সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। আর ঘুমালেও আপনিই ছিলেন স্বপ্নের পুরোটা জুড়ে। এইগুলোর কিছুই বলবো না আমি। আপনিই বলবেন সব। আমি পারছি না আর। এই পথে হাঁটতে পারি না। বার বার মনে হয় নিজেই সবটা বলে দিই। কিন্তু কেন বলবো? আমি তো মেয়ে। আমার লজ্জা করে আপনাকে ভালোবাসি বলতে। আপনিই বলুন। আর হ্যাঁ শুধু এটা বলছি যে আমার নাম নাঈমা। এবার যা বলার আপনিই বলবেন। আমি কিছুই বলবো না। এমন কী ভালোবাসি কথাটাও না।
    .
    কথাগুলো বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠে নাঈমা। নীল হাসে। ছেলে হাসিটা এত দূর থেকেও চোখ এড়ায় না বাবা। চোখের কোণেটা কী একটু ভিজে উঠেছে? হুম তাই তো। সাবধানে মুছে নেন ভদ্রলোক।
    .
  • ভালোবাসি তোমাকে, সেই প্রথম দিন থেকেই তোমাকে দেখার ব্যাকুলতা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। রোজ বসে থাকি একটু খানি দেখার জন্য। তাতে যদি একদিনও ছেদ পড়ে তাহলে সারাদিন অতৃপ্তির অস্থিরতায় কাটে । কী করবো আমি তুমিই বলে দাও।
    .
    কথাগুলো শুনে মাথা উঁচু করে নাঈমা। দুইজনের চোখে চোখ পড়ে যায় কিছু সময়ের জন্য।
    .
  • ঐ যে উনি কে? যার সাথে আপনি কথা বলছিলেন? আমি দেখেছি আমি আসতেই উনি আপনাকে কী যেন বললো।
    .
    টঙয়ের দোকানের দিকে ইশারা করে বলে নাঈমা। নীল সেদিকে তাকিয়ে বলে,
  • উনি আমার বাবা, বন্ধুও বলতে পারো।
    .
  • উনাকে বলে দিবেন যে শ্বশুর হিসাবে উনাকেই চাই আমার।
    .
    কথাটা বলেই হাঁটা শুরু করে নাঈমা। এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে নীল। মেয়েটাও একটু খানি যেতেই বার বার ফিরে ফিরে তাকালো বেশ কয়েকবার। মুখে এক দুষ্টু হাসি, বিজয়ীনির হাসি। নীল একটু উঁচু গলায় বলে,
  • আর আমার উত্তরটা?
    কথাটা শুনে হাঁটতে হাঁটতে আবারও পিছন ফিরে তাকায় নাঈমা। তারপর বলে,
  • বুদ্ধু।
    তারপর আবার মুখ টিপে হাসতে হাসতে চলে যায় মেয়েটা। আর সেই হাসি দেখে নীলের মুখেও ফুটে উঠে হাসির ঝলক। হাসিটা এড়িয়ে যায় না বাবার চোখ, চোখটা ভিজে উঠে আরেকবার। তবে এ অশ্রু ব্যথার নয়, প্রাপ্তির ।
    .
    _সমাপ্ত।
    .
    গল্পের নামঃ প্রাপ্তি
    .
    লিখেছেনঃ Sajib Mahmud Neel

Send private message to author
What’s your Reaction?
6
11
0
0
0
0
1
Sajib Mahmud Neel
Written by
Sajib Mahmud Neel
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!