রুমির মনে ঢাক গুড়গুড় করছে। সুমনকে না জিজ্ঞেশ করেই সে একটা কাজ করেছে। ফেসবুকে রিসাইকেল বিন গ্রুপে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ড্রেসিং টেবিল দেখে নিতান্ত কৌতুহল বশত ইনবক্সে দামাদামি করতে গিয়ে ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। ড্রেসিং টেবিলের মালিক মাত্র পাঁচশো টাকায় ওটা দিয়ে দেবে বলেছে, তবে শর্ত একটাই। আধা ঘন্টার মধ্যে লোকটার দেয়া ঠিকানায় গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। রুমি এখন কি করবে? ড্রেসিং টেবিলটা এত্ত সুন্দর! কালো কাঠের নকশি করা বর্ডার, এক পাশে মাথা থেকে পা পর্যন্ত আয়না, তার পাশে খোপ খোপ করা কাঠের শেলফ। এটা নাকি আবলুশ কাঠের তৈরী। মিশর থেকে এসেছিল। মালিক দেশ ছেড়ে চলে যাবে, তাই তাড়াহুড়া করে বাসার সব কিছু রিসাইকেল বিনে পোস্ট দিয়ে বিক্রি করে ফেলছে। ইনবক্সে রুমিকে তাই বলেছে। কিন্তু সুমনকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে ভয় লাগছে। যদি রেগে যায়? আবার এত ভালো অফার নাকচ করতেও মন মানছে না। সবচেয়ে বড় কথা লোকটার বাসা শনির আখড়াতে । রুমির বাসা থেকে রিকশা নিলে দশ মিনিটের রাস্তা। আচ্ছা, রুমি যদি একটা ভ্যান গাড়ি ভাড়া করে আয়নাটা নিয়ে আসে, সুমন কি দেখে অবাক হবেনা? হওয়াতো উচিৎ। এত সস্তায় এত ভালো জিনিস সুমন নিজে কখনোই যোগাড় করতে পারতোনা। রুমি তার টিনের বাক্স খুলে দেখে। টুকটাক করে জমাতে জমাতে সাড়ে তিন হাজার টাকা হয়েছে। এই টাকা শুধুই রুমির। এখান থেকে পাঁচশো টাকা খরচ করলে সুমন কি ক্ষেপে যাবে? গেলে যাক, জীবনে তো মাঝে মাঝে শখ আহ্লাদকেও গুরুত্ব দিতে হয়। রুমি আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে পরে। পথে যেতে তার পুরোনো কথা মনে পড়ে।

সুমন অফিসে চলে যাওয়ার সময় সেদিন একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল রুমির সাথে, সে জন্য আকাশ মেঘলা! সুমন-রুমির ঢাকাতে নতুন সংসার।  ওদের বিয়ের যদিও বা এক বছরের উপরে বয়স, তবে রুমি এতদিন গ্রামেই ছিল শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে। কিন্তু এভাবে কাঁহাতক! তিন চার মাসে সুমন একবার গ্রামে যাওয়ার সুযোগ পায়, তাও মাত্র দেড় দিনের জন্য। দুই রাত তো জার্নিতেই কেটে যায়। আর একা একা মেসে বুয়ার রান্না খেয়ে ওরও পেটের হাল বেহাল। তাই শেষ পর্যন্ত বাবা-মাকে বুঝিয়ে রুমিকে ঢাকায় নিয়ে এলো। ওর চাকরীটা যেমন-তেমন। রুমিকে আগেই বলেছে-খুব বেশী দরকারি  না হলে সাংসারিক কোন জিনিস এখন কিনে দিতে পারবেনা। যাত্রাবাড়ির ঘিঞ্জি একটা অ্যাপার্টমেন্টে এক বেডরুমের ফ্ল্যাট যোগাড় করতেই ওর জান বেরিয়ে যাওয়ার দশা। দশ কদম হেঁটে এলে বাসাটা পুরো চক্কর দিয়ে দেওয়া যায়, তাতেই মাসে মাসে চার হাজার করে টাকা চলে যাবে। তা যাক, এর চেয়ে কম ভাড়ায় কি বৌকে নিয়ে বস্তিতে তুলবে? রুমি লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। কোন কিছুতে আফসোস-অভিযোগ নেই। সংসারের কোন জিনিসই পছন্দ করে কিনতে পারেনি, তাতে ওর রা নেই। খাট কিনা হয়নি ওদের, মেঝেতে তোষকে চাদর বিছিয়ে ঘুমায়। রট আয়রনের একটা আলনা, কিচেনের একটা শেলফ, আর হাড়ি-পাতিল- ঢাকায় প্রথম মাসে শুধু এইটুকু আসবাব দিয়ে ওরা নতুন জীবন শুরু করেছে। তবু মেয়েমানুষের মন! নিজেকে মাঝে মাঝে আয়নায় একটু দেখতে ইচ্ছে করে, সাজতে ভালো লাগে! একটা ড্রেসিং টেবিল কি সামনের মাসে কেনা যাবে- এই প্রশ্ন করতেই সুমন একটু রেগে যায় সেদিন! “বাথরুমের আয়না দিয়ে তোমার পোষাচ্ছেনা?”- খানিকটা রূঢ় কন্ঠে রুমির দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে তাড়াহুড়া করে অফিসের জন্য বেরিয়ে যায়। সেই থেকে ক্ষণে ক্ষণে বরষার জলধারা বইছিল রুমির চোখে!

এরপর আস্তে আস্তে টুকটাক করে এটাসেটা কেনা হচ্ছে ওদের। কিন্তু রুমি আর কখনো আগ বাড়িয়ে ড্রেসিং টেবিল কিনতে চায়নি। সুমন যদি মনে করে অন্য আসবাবের প্রয়োজন বেশী-তাহলে আগে ওগুলোই কিনা হবে। তবে আজ ফেসবুক ঘাটতে গিয়ে ওর কপালটা মনে হয় খুলেই গেল। এমনিতে রিসাইকেল বিন গ্রুপটাতে মানুষজন মনগড়া দাম হাঁকিয়ে রাখে সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিশের। কিন্তু এই পোস্টে বিক্রেতা কোন দাম দেয়নি। বলেছে-আলোচনা সাপেক্ষে। কী ভেবে রুমি লোকটাকে ইনবক্সে নক করে। রুমিকে কোন প্রশ্ন করতে না দিয়ে বলতে থাকে- কিনতে হলে আজকের মধ্যেই নিতে হবে, রুমি যেন একটা দাম বলে নিয়ে যায়। রুমি একটু অবাক হয়, এত তাড়াহুড়া কেন? এদিক দিয়ে বেচারিকে একটু আনাড়িই বলা যেতে পারে। লোকটার প্রফাইল ঘেঁটে যে দেখবে, আসল না ফেইক, তাও করার কথা তার মনে থাকেনা। লোকটা যখন বলল- “আমার শখের জিনিশ, টাকার দরকার নেই, চলে যাব বলে বিক্রি করব, আপনিই একটা দাম বলুন”- রুমি ধরেই নিয়েছিল, ড্রেসিং টেবিলটা সে কিনতে পারবেনা। একে তো বিদেশী কাঠের জিনিশ, তারউপর এটা নাকি শখের বস্তু, তবু কিছু একটা বলতে হয়, তাই দাঁত-মুখ খিঁচে টাইপ করেছিল-“পাঁচশো টাকায় দিবেন?” লেখাটা সেন্ড করে সারতে পারেনি, তখনই টুং করে ম্যাসেঞ্জারে শব্দ-মানে লোকটা রিপ্লাই করে ফেলেছে। রুমি ভাবছিল ওকে হয়ত যা তা বলে অপমান করবে, কিন্তু দেখে-সেখানে লিখা-“ ঠিকানা দিচ্ছি, নিয়ে যান, তবে আধা ঘন্টার মধ্যে আসবেন”। আহ, এমনও ভাগ্য মানুষের হয়!!

*********

 বাসায় ফিরে সুমন সেদিন একটু অবাক হয়, তবে মনে মনে খুশিও হয়। যাক, বৌটা তার একেবারে ফেলনা নয়। বুদ্ধিসুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে পারে। আসলেই, সুমনের পক্ষে ওকে এত দামী ড্রেসিং টেবিল কখনোই কিনে দেওয়া সম্ভব হতোনা। ওদের সাদামাটা ঘরটাতে কেমন যেন রাজকীয় ভাব চলে এসেছে আয়নাটা রাখায়। রুমির তো খুশির বাঁধ মানছেনা। সময় পেলেই আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। তার উপর সুমন রাগ করেনি দেখে ওর আনন্দ আজ দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে। ড্রেসিং টেবিলটার দিকে তাকিয়ে রুমি ভাবে- এটার আগের মালিক একটা হতভাগা- এত সুন্দর জিনিশটা হাতছাড়া করলো! কী সুন্দর তেলতেলে কালো কাঠের একটা শিল্পকর্ম, নিশ্চয়ই কারিগর অনেক বড় মানের শিল্পী। কী নিখুঁত করে ফিনিশিং দেওয়া। ভালো করে লক্ষ্য করেও রুমি কাঠের মধ্যে কোন জোড়া দেওয়া দেখতে পায়না। তবে কি একটা আস্ত গাছের কান্ড দিয়েই পুরো জিনিশটা বানানো? রুমি যতই দেখে, ততই মুগ্ধ হয়। ড্রেসিং টেবিলটা নিজে না যত সুন্দর, তারচেয়ে বড় কথা- এর সামনে দাঁড়ালে রুমির নিজেকে অনেক বেশী সুন্দর লাগছে! যাহ, অতি খুশিতে মাথা নিশ্চয়ই বিগড়ে যাচ্ছে আমার- মনে মনে একগাল হেসে নেয় রুমি । সে ঠিক করে, জীবনে যত ঝড়-ঝঞ্ঝা আসুক, এই ড্রেসিং টেবিল সে কখনো কাউকে দেবেনা। বরং তার বংশের উত্তরাধিকারদের যুগে যুগে এটা যত্ন করে রাখার আদেশ দিয়ে যাবে সে।

******

কলিং বেল চেপে সুমন বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। রুমি দরজা খুলতে এত দেরী করছে কেন? ইদানিং প্রায়ই এমন করছে মেয়েটা। সে জানেনা, সাড়ে পাঁচটায় প্রতিদিন সুমন বাসায় আসে? তার কোন কাজ থাকলে সেটা পরে করতে পারেনা? আজ একটু কড়া কথা শোনাতে হবে ওকে- ভাবনাটা শেষ না হতেই রুমি দরজা খুলে দেয়। সুমন কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়। রুমিকে এত সুন্দর লাগছে আজ! মেয়েটা দিন দিন সুন্দর হচ্ছে। অথচ ও তো এমন ছিলনা। গ্রামের সাধারণ চেহারার একটা মেয়ে,চেহারায় কোমলতা আছে, কিন্তু উপচে পড়া তেমন কোন রূপ নেই। কিন্তু কিছুদিন ধরে রুমির চেহারায় আশ্চর্য এক সৌন্দর্য যেন কোথা থেকে ভর করেছে। সুমনের রাগ পানি হয়ে যায়। কেমন ঘোর লাগা ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে সে জামা ছাড়তে শুরু করে। রুমি এসে বিছানার উপর বসে। ওর বসার ভঙ্গিও কেমন যেন বদলে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে সিংহাসনে আসীন কোন সম্রাজ্ঞী! “রুমি, তুমি দিনদিন এত সুন্দর হচ্ছ কীভাবে, বলোতো?” আগে সুমনের তরল রসিকতায় রুমি খিলখিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ত। আজ ঠোঁটের কোনে অদ্ভুত এক মুচকি হাসি ধরে রেখে রুমি উত্তর দেয়-“দেখার মত আগে কখনো দেখেছ?” সুমন ভাষা খুঁজে পায়না! এ কোন রুমি? এমন রহস্য করে কথা বলা শিখেছে সে কোথা থেকে? এ তো তার সহজ-সরল গ্রাম্য সেই বধু নয়। রাতে ঘনিষ্ট আলিঙ্গনেও সুমনের অস্বস্তি হতে থাকে। রুমির মধ্যে কী একটা পরিবর্তন এসেছে, ও ধরতে পারছেনা। মনে হচ্ছে- এ যে কোন আকাশের চাঁদ, যাকে সুমনের মত ছা-পোষা লোকের বাহুবন্ধনে থাকা মানায় না!

*******

সুমন ঘুমের মধ্যে ঘেমে নেয়ে উঠে। খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখছিল সে। ওর রুমি যেন আর রুমি নয়- অন্য এক নারী। যার হাতে একটা কারুকাজ করা কাঁচের ছুরি!। সে সুমনকে পেছন থেকে আদর করার ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরে ওর গলায় ছুরিটা দিয়ে পোঁচ মেরে দেয়। চিৎকার দিয়ে উঠে বসে সুমন নিজের গলায় হাত বুলিয়ে পরখ করে নেয়। ওর বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা এত জোরে শব্দ করছে, সুমনের আশংকা হলো-তার আওয়াজে না রুমির ঘুম ভেঙ্গে যায়! কিন্তু কোথায় রুমি? আশ্চর্য, এত রাতে কোথায় গেছে? সুমন বেডরুম থেকে বের হয়ে কিচেনটা ঘুরে আসে। ওদের ফ্ল্যাটে বাথরুমটা কমন স্পেসে। কিচেন আর ছোট্ট বসার ঘরটার সাথে লাগোয়া। সবখানেই দেখা হয়েছে-রুমি নেই! সামনের দরজাও তো খোলা নয়। ঘুমানোর আগে প্রতি রাতে সুমন নিজ হাতে দুইটা ছিটকিনি তুলে দেয়, সেগুলো তেমনিই তোলা আছে। “রুমি, রুমি”- ভাঙ্গা গলায় ভয়ার্ত কন্ঠে সুমন হাঁক ছাড়তেই বেডরুম থেকে “উঃ”- রুমির আওয়াজ শোনা গেল! এইতো রুমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে ছোট টুলটাতে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছেনা ও ঘুমিয়ে ছিল। পরিপাটি চুল,মুখে হালকা প্রসাধনের মত- যেন এইমাত্র কোথা থেকে বেরিয়ে এল। হঠাত সুমনের ইচ্ছে হলো দরজা খুলে ছুটে পালিয়ে যায়। ওর মাথায় খুব ভয়ংকর একটা ভাবনা এসেছে। ওর মনে হচ্ছে-রুমি এতক্ষণ আয়নার মধ্যে ছিল। এইমাত্র আয়না থেকে বের হয়ে টুলটাতে বসেছে। কিছু বলার আগেই রুমি আদুরে গলায় বললো- রাত দুপুরে কী স্বপ্ন দেখে রুমি রুমি করছ? আমি আছি তো এখানেই। চলো ঘুমাবে”। সুমন আর কিছু বলতে পারলোনা। ভয়ে কাঠ হয়ে এক সাইডে শুয়ে পরে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। অতিরিক্ত উত্তেজনার কারনেই কি না কে জানে, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ও আবার ঘুমে তলিয়ে যায়। সকালে নিয়মুমত ঘুম ভেঙ্গে রাতে ভয় পাওয়ার কথা সুমনের কাছে হাস্যকর লাগে। কী সব আজগুবি ভাবছিল, ভাগ্যিস রুমিকে কিছু বলেনি। সারাদিন একা একা বাসায় থাকে মেয়েটা, ভয় পেয়ে যাবে।

*******

“রুমি, চলো, আজ আমরা বাইরে খাব। সুন্দর দেখে একটা শাড়ি পরো তো।“

“কী হলো, এখনো রেডি হওনি? আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকি, তোমার দেখি কোন গরজই নেই।অথচ যুগে যুগে জামাইরাই নাকি খোঁটা শুনে আসছে-বিয়ের তারিখ মনে না রাখার জন্য। আর আমার ঘরে সব উল্টো কাহিনি।“

“ এই রুমি, কতক্ষণ ধরে একাই বলে যাচ্ছি, তুমি কিছু বলছোনা কেন? মুখ ভার কেন? কী হয়েছে? এই, এই রুমি!”

“হুম?” সুমনের মৃদু চিৎকারে যেন ধ্যান ভেঙ্গে জেগে উঠলো রুমি। “ আমি কোথাও যাবোনা গো। তুমি যাও”।

“একা একা যাবো অ্যানিভার্সারি পালন করতে? তোমার মাথা ঠিক আছে? না তুমি আর আমাকে ভালোবাসোনা? সত্যি করে বল, কী হয়েছে। ক’দিন ধরেই দেখছি-আমার দিকে তোমার কোন খেয়াল নেই। আমি বাসায় না থাকলেই যেন তুমি খুশি।“

“সুলতানা আমাকে কোথাও যেতে দিবেনা, ওর একা একা লাগে”।– রুমির চোখ হঠাত পানিতে ভর্তি হয়ে যায়। মনে হয় যেন অনেক কষ্টে ওর মুখ দিয়ে ওর কথাটা বের হয়েছে। কিন্তু সাথে সাথেই একটা ভয়ের ছায়ায় কোমল মুখটা কালচে হয়ে যায়। বুঝিবা এইটুকু বলে ফেলে ও কোন অপরাধ করে ফেলেছে, এখন ওকে শাস্তি পেতে হবে।

সুমনের মাথায় যেন কে হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। “কী? কী বললে? কে তোমাকে যেতে দিবেনা? সুলতানা কে?”

“না না কিছুনা। চলো বাইরে যাই”- সেই থেকে যে রুমি মুখে তালা দিল- সুমনের হাজার অনুরোধ, চোখ রাঙ্গানোতেও এ বিষয়ে সে আর কিছু বলতে রাজি হলোনা। বারবার বললো মনের খেয়ালে মুখ ফসকে একটা কথা বলে ফেলেছে, সুমন যেন এটা নিয়ে মাথা না ঘামায়। সুমন হাল ছাড়ার পাত্র নয়। সন্ধ্যাবেলা রুমিকে বাসায় একা রেখেই সে তার বন্ধু কমলের বাসায় গিয়ে হাজির হল। কমল একটু পাগলা কিসিমের। ওর বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর। কমল ছোটবেলা থেকেই অনেক বই পড়েছে। পুরো বিশ্বের ইতিহাস ওর জানা। পড়ুয়া বলে যে কোন থিওরিই সে খুব গুরুত্ব দিয়ে যাচাই করে দেখে। তাই ওকেই নিজের সন্দেহের কথা খুলে বলতে সুমনের সাহস নয়। অন্য কেউ হলে ওর কথা নির্ঘাত হেসে উড়িয়ে দিত। কিন্তু কমল খুব সিরিয়াস হয়ে গেল।“ ওই আয়নাটা যে বিক্রি করেছে, তার ঠিকানা দিতে পারবি?” “না, লোকটা ফেইক আইডি থেকে পোস্ট করেছিল। রুমি যেদিন ড্রেসিং টেবিল কিনে আনে, সেদিনই আমি আবার লোকটাকে ম্যাসেঞ্জারে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে দেখি, প্রোফাইল একদম সাদা ফকফকা। আর আমার ধন্যবাদের উত্তরে কিছু বলেও নি। তখন ওর দেওয়া ঠিকানায়ও পরদিন গিয়েছিলাম-সামনা সামনি কথা বলার জন্য। লোকটাকে পাইনি। আমার খটকা লাগলেও আর বেশী ঘাটাইনি ব্যাপারটা নিয়ে, কারন জিনিশটা আসলেই অনেক সুন্দর আর দামী ছিল।“ সব শুনে কমল আরো গম্ভীর হয়ে যায়। ওদের ড্রইং রুমের চার দেয়ালে মেঝে থেকে ছাঁদ পর্যন্ত বইয়ে ঠাসা তাক। সেখান থেকে কিছুক্ষণ খুঁজে একটা বই বের করে। কিছু একটা পড়ে শ্যামবর্ণের মুখটা কালো হয়ে যায়।

“আমার মনে হচ্ছে, আয়নাটায় কোন আত্মা বা এই জাতীয় কিছু আছে। হয়তো রুমি ভাবীর উপর ভর করেছে। তুই ই তো বললি-উনার চেহারা, কথাবার্তা সব বদলে গেছে। আর মিশর থেকে এসেছে বললি না? ঐসব জাদুটোনা, মমি, প্রেত-সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল একসময় মিশর। তুই এক কাজ কর, আয়নাটাতে আগুন ধরিয়ে দে। ভিতরে যাই থাকুক, নষ্ট হয়ে যাবে”।

বাসায় আসতে আসতে সুমনের হাসি উঠে যায়। কমলের কাছে যাওয়াটা মনে হয় বাড়াবাড়ি হয়েছে।ওর কল্পনার ঘোড়া যে এত দূর দৌঁড়াতে পারে, সুমনের ধারনা ছিলনা। কোথা থেকে মমি, মিশর সব একসাথে ঘুটা দিয়ে জগাখিচুড়ি এক থিওরি দাঁড় করিয়ে ফেলল। অস্বাভাবিক কিছু একটা অবশ্যই আছে আয়নাটার সাথে, তাই বলে এত? রুমি আজও দরজা খুলতে দেরী করছে। আচ্ছা, দেখা যাক একটা ব্যাপার পরীক্ষা করে। সুমন বাসার বাউন্ডারি দেয়ালের সাথে লাগোয়া চিপা গলি দিয়ে ওর বেডরুমের জানার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালাটা বন্ধ থাকলেও দুই পাল্লার মাঝে সরু একটু ফাঁকা আছে। রুমি অনেক দিন বলেছে ফাঁকাটা বন্ধ করে দিতে, চোর চোট্টার ভয় আছে। সেই ফাঁকা দিয়ে বেডরুমের দিকে তাকাতেই সুমনের গলা শুকিয়ে যায়। রুমি ড্রেসিং টেবিলের আয়নাতে নিজেকে দেখছে আর কথা বলছে। কিন্তু সে আর তার প্রতিবিম্ব একই কথা বলছেনা।রুমি যখন বলছে তখন আয়নার তার ছায়াটা চুপ করে শুনছে। এরপর রুমি থামলে সে উত্তর দিচ্ছে। সুমন আর দেখার সাহস পায়না। চট করে ওখান থেকে সরে এসে দরজার বাইরে কিছুক্ষন নিজেকে সামলিয়ে নেয়। এখনো হয়ত সময় আছে, রুমিকে আর নিজেকে বাঁচানোর। “রুমি রুমি”- বলে জোরে জোরে কয়েকবার ডাক দিলে দরজা খুলে গেল। সুমন ওর দিকে ভালো করে তাকায় না। “ জলদি চলো রুমি, বাড়ি থেকে ফোন এসেছে, আব্বার শরীর ভালোনা, আমরা এখনই যাবো”। রুমি কী যেন বলতে চায়, কিন্তু সুমন ওকে সেই অবস্থাতেই ঠেলতে ঠেলতে বাসার বাইরে এনে দরজার তালা দিয়ে দেয়। রুমির হাত ধরে প্রায় টেনে টেনেই বড় রাস্তায় গিয়ে একটা রিকসায় উঠে। সায়দাবাদ যাওয়ার কথা বলে কমলকে ফোন দেয়। বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখে কমল ইতিমধ্যে চলে এসেছে। দুটো টিকেট কেটে রুমিকে নিয়ে বাসে উঠে। কমলের হাতে বাসার চাবিটা দিয়ে দুই বন্ধুতে চোখে চোখে কথা হয়ে যায়। বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত রুমি অনেক চেষ্টা করে সুমনের হাত ছাড়িয়ে বাস থেকে নেমে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সুমন ওকে জান দিয়ে হলেও আগলে রাখবে। বাস না ছাড়া পর্যন্ত কমল সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে।

********

সুমনের বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে কমল থরথর করে কাঁপছে। প্রাণটা এখনো দেহের মধ্যে আছে- এ নেহায়েত ওর বাবা মায়ের দোয়া। রুমির ড্রেসিং টেবিলে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পরে কমল তার চৌদ্দগুষ্টীর কসম খেয়ে বলতে পারবে, আয়নার ভেতর থেকে অসহায় আর্ত চিৎকার শুনতে পেয়েছিল সে। কিন্তু সবজান্তা কমল হয়তো ভুলে গিয়েছিল- আবলুশ কাঠে আগুন ধরেনা। যখন কাঠের গায়ে বিন্দুমাত্র দাগ পড়েনি, বরং তেল পুড়ে শেষ হওয়ার পর আগুন নিভে গিয়েছিল- নিজের চোখের দেখাকে গুরুতর বিভ্রম বলে মনে হয়। কোনমতে ফোনটা বের করে ড্রেসিং টেবিল এর একটা ছবি তুলে সে বাসা থেকে বের হয়ে আসে।দরজায় তালা দিতে দিতে শেষ চেষ্টা হিসেবে  আরেকটা বুদ্ধি ঝালিয়ে দেখার কথা মনে পড়ে।

*******

আলেয়ার কী যে ভালো লাগছে। অনেক দিন পরে মনের মত একটা জিনিশ কিনা গেল রিসাইকেল বিন গ্রুপ থেকে। মাত্র পাঁচশো টাকায় আবলুশ কাঠের ফার্নিচার, বাপের জন্মে কেউ কখনো কল্পনা করেছিল?

******

সুমন বুঝতে পারছেনা কী করলে তার সংসারে শান্তি ফিরে আসবে! তার লক্ষ্মী বউটা এমন ছন্নছাড়ার মত আচরণ করছে ইদানিং, নিজে থেকে কথা বলতে চায়না, নাম ধরে ডাকলেও ফিরে তাকায় না। মনে হয় সারাক্ষণই কোন ঘোরের মধ্যে আছে। আজ কী ভেবে সুমন ওকে ডাক দিল- “সুলতানা?”- সাথে সাথে রুমির চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দেখা গেল!

****

আলেয়া ভালোই আছে, তবে মাঝে মাঝে ওর কী যেন হয়! ওর মনে হয় ও যেন আলেয়া নয়, যেন ওর নাম রুমি!!!

-মেহজেবীন আক্তার ( Mahjabeen Akter)

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
0
0
0
1
0
2
Mahjabeen Akter
Written by
Mahjabeen Akter
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!