আক্ষেপ

নাস্তা করার জন্য খাবার টেবিলে বসে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে আম্মাকে বললাম,

  • ভালো লাগে না,আম্মা। সবকিছুই কেমন যেন পানসে লাগে।

আম্মা আমার কাছে এসে মাথায় হাত দিয়ে আহ্লাদের স্বরে বলল,

  • আমার ছেলেটা একদম না খেতে খেতে পেন্সিলের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে।কি খেতে ইচ্ছে করছে বল আমাকে?
    আজকে যেটা বলবি সেটাই রান্না করবো।

বুঝতে পারলাম আম্মার মন আজকে খুব ভালো।সচরাচর আম্মার মন এত ভালো থাকে না।

আমি কোনোকিছু না ভেবেই আম্মাকে বললাম,

  • গরুর মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করো।অনেকদিন ধরে তোমার হাতের বিরিয়ানি খাওয়া হয় না।

আম্মা আমার হাতে একটা বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল,

  • এই নে ব্যাগ। বাজার থেকে গরুর মাংস আর পোলাও এর চাউল কিনে নিয়ে আয়।

সাথে আরো কি কি যেন মসলার কথা বলল সব মাথার উপর দিয়ে গেল।

আমি আম্মাকে বললাম,

  • একটা কাগজে লিখে দাও।সাথে বাজারের জন্য টাকা দাও সব নিয়ে আসছি।
  • টাকা কেন দিবো তোকে?
    নিজের টাকা দিয়ে বিরিয়ানি খাবি।আমি শুধু মা হিসেবে রান্না করে দিবো।
  • টাকা কোথায় পাবো, আম্মা?
    আমি তো রোজগার করি না।
  • তাহলে প্রতিদিন এই সব আজগুবি আবদার আমাকে করবি না।যেদিন নিজে টাকা-পয়সা কামাবি সেদিন এইসব আবদার করবি।এর আগ পর্যন্ত আমি যা রান্না করবো তাই চুপচাপ বসে বসে গিলতে হবে।

আমি চায়ের কাপে শেষবারের মতো চুমুক দিয়ে বললাম,

  • সামান্য একটু বিরিয়ানি রান্না করতে বলেছি বলে তুমি আমাকে টাকা-পয়সা নিয়ে কথা বলতো পারো না আম্মা।
  • তোর বাবার টাকায় পুরো সংসার চলছে।তোর বাবার মুখে তো এইসব আবদার কখনও শুনি না।
  • আম্মা, তুমি কিন্তু আমার মানসম্মান নিয়ে কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছো এখন।
  • তোর সেটা আছে, যেটার কথা বললি?

আমি টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,

  • যে বাসায় সামান্য একটু বিরিয়ানি রান্নার কথা বললে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি লাগে সেই বাসায় আমি থাকবো না।চলে যাচ্ছি যেদিকে দুচোখ যায়।

আমার চলে যাওয়া দেখে আম্মা পেছন থেকে বলল,

  • তোর দুই চোখ যেন এই বাসার দিকে আর নজর না দেয়।

এক বুক কষ্ট নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি।
হঠাৎ একজন অপরিচিত মেয়ে আমার হাতের আঙুল ধরে বলল,

  • ভাইয়া, পেছনে দুইটা ছেলে আমাকে অনেকক্ষণ ধরে ফলো করছে।আপনি আমার সাথে একটু হেসে কথা বললে ওরা ভাববে আমাদের মধ্যে খুব ভালো একটা সম্পর্ক বিদ্যমান।

মেয়েটির কথা শুনে পেছনে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম ঘটনা সত্য।

এরপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

  • আপনার নাম কি?

মেয়েটিও হেসে জবাব দিলো,

  • আমার নাম জানার বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই আপনার।আমি এই সামনের এলাকায় থাকি।
  • রাস্তায় এত মানুষ থাকতে আপনি আমার কাছেই কেনো আসলেন সাহায্যের জন্য?
  • আপনাকে দেখে একটু বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল।আপনার চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব আছে।

মেয়েটির মুখে এই কথা শুনার পর আমার ভেতরে জমে থাকা এক বুক কষ্ট সাথেই সাথেই সুখে পরিনত হলো।

কিছুক্ষণ পর মেয়েটি আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বলল,

  • ছেলে দুইটা চলে গেছে।আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।

আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম,
“ছেলে দুইটা আরেকটু থাকলে তো ভালোই হতো।অপরিচিত মানুষের মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে তো ভালোই লাগছিলো।”

কিছুক্ষণ পর মেয়েটি রাস্তা থেকে চলে গেল।

মেয়েটি চলে যাওয়ার পর আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি মেয়েটা বোধহয় আমাকে পছন্দ করে ফেলেছে।তা না হলে এভাবে রাস্তায় হাত ধরে ফেলতো না।দেখতে শুনতেও খারাপ না।এরকম একটা মেয়ে যদি আমার জীবনসঙ্গী হতো তাহলে মন্দ হতো না।

হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ঢুকেই আম্মাকে বললাম,

  • খুব ক্ষুধা লেগেছে আম্মা।যা রান্না করেছো তাই নিয়ে আসো।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আম্মা বলল,

  • বাসা থেকে চলে গেলি মন খারাপ করে এখন আবার ফিরে আসলি হাসিমুখে কাহিনী কি?
  • রাস্তায় তোমার হবু পুত্রবধুর সাথে দেখা হয়েছিলো আম্মা।
    সে কি দৃশ্য!
  • কাহিনী খুলে বলতো শুনি।

আম্মাকে সব কাহিনী খুলে বললাম।

আম্মা সব কাহিনী শুনে বলল,

  • মেয়েটা বিপদে পরেছিল তাই তোর কাছে সাহায্য চেয়েছে।এটা নিয়ে আকাশকুসুম চিন্তা করার তো কিছু দেখছি না।
  • আকাশকুসুম চিন্তা ভাবনা কোথায় করলাম,আম্মা।আমি তো বাস্তব কথাগুলোই তুলে ধরলাম।আর একটা বিষয় খেয়াল করেছো, রাস্তায় এতগুলো মানুষ থাকতে মেয়েটা কিন্তু আমার কাছেই এসেছিলো।
  • তোকে দেখতে বোকাসোকা ভেবেছে তাই তোর কাছে এসেছে।
  • মেয়েটা বলেছে আমার চেহারায় নাকি মায়া মায়া ভাব আছে।

আমার কথাশুনে আম্মা হাসতে হাসতে বলল,

  • বিপদে পরলে তো নিজের শত্রুও প্রশংসা করে রে বোকা।
  • আম্মা তুমি কিন্তু আবারও আমাকে অপমান করে কথা বলছো।
  • আমার কথা ভালো না লাগলে কিছুদিন পর যখন আপসোস করবি তখন খুব ভালো হবে।

আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে টেবিল থেকে উঠে পরলাম।

কিছুদিন পর মেয়েটির সাথে পার্কে আবার দেখা হলো।আজ মেয়েটি একা না, সাথে একটা ছেলেকে নিয়ে হাঁটছে।

মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

  • কেমন আছেন,ভাইয়া?

আমার মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না।তবুও জোর করে আওয়াজ বের করার চেষ্টা করে বললাম,

  • জি, ভালো।

মেয়েটি তখন পাশে থাকা ছেলেটিকে বলল,

  • তোমাকে ঐদিন একটা ভাইয়ার কথা বলেছিলাম না?
    রাস্তায় আমাকে সাহায্য করেছিলো, এই সেই ভাইয়া।

ছেলেটি তখন আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

  • আপনি একদম ওর ভাইয়ের মতো কাজ করেছেন।আপনার সাথে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগলো।

কথাবার্তা শুনে যা বুঝলাম, তাদের মধ্যে যে সম্পর্ক চলছে সেটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া খুব কষ্টদায়ক।

বিদায় নিয়ে চলে আসবো তখন মেয়েটি বলল,

  • ভাইয়া আজকে আরেকটা উপকার করতে পারবেন?
  • জি,বলেন।

আমার হাতে একটা মোবাইল দিয়ে বলল,

  • আমরা দুজন একসাথে দাঁড়াবো আপনি সুন্দর করে দুই-তিনটা ছবি তুলে দিতে পারবেন?

আমি মনের মধ্যে একবুক কষ্ট নিয়ে আর মুখে হাসি প্রকাশ করে বললাম,

  • কেন নয়?
    হাত যেহেতু আছে ছবি তুলতে কীসের আপত্তি!
    আপনারা দাঁড়ান আমি তুলে দিচ্ছি।

তারা খুব কাছাকাছি দাঁড়ালো আর আমিও তিন-চারটা ছবি তুলে দিয়ে পার্ক থেকে চলে আসলাম।

এখন হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি,
” কিছুদিন আগে যেই মেয়ের কাছে একবুক কষ্ট জমা দিয়ে সুখ কুড়িয়ে এনেছিলাম আজ আবার তার কাছ থেকেই এক বুক কষ্ট নিয়ে ফিরছি।কিন্তু এটা তো হবার কথা ছিল না।”

আজকে বাসায় গিয়ে মনমরা হয়ে বসে আছি।
আমার ক্লান্ত চেহারা দেখে আম্মা বলল,

  • আজকে আবার কি হয়েছে তোর?

আজকেও আম্মাকে সব কাহিনী খুলে বললাম।

আমার কাহিনী শুনে আম্মা বলল,

  • আমি তো আগেই বলেছিলাম আকাশকুসুম চিন্তা করিস না।পরে আপসোস করতে হবে।এখন তো আমার কথা সত্যি হলো।
  • আমি তো হাল ছেড়ে দিচ্ছি না, আম্মা।মেয়েটার তো এখনও বিয়ে হয়নি।আর বিয়ের আগে এরকম সম্পর্ক অনেক দেখেছি বন্ধুবান্ধবদের। খুব কমই দেখেছি বিয়ে পর্যন্ত যেতে।
  • তাহলে তুই কি চিন্তা করলি?
  • মেয়েটারও একদিন সম্পর্কে ফাটল ধরবে আম্মা।তখন সেই ফাটল টা আমি পূরণ করে দিবো।সেজন্য প্রচুর ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে।

আমার কথায় রেগে গিয়ে আম্মা বলল,

  • অন্য কোনো সময় তো এত ধৈর্য্যশীল হতে দেখি না।পড়াশোনার সময় যদি এরকম ধৈর্য্যশীল হতে পারতি তাহলে আজকে এদিন দেখতো হতো না। যা ইচ্ছা কর, আপসোস করে তো শেষমেশ আমার কাছেই আসতে হবে।এখনও সময় আছে ভালো হয়ে যা।

আম্মার কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে নিজের মতো চলতে লাগলাম।

এরপর এভাবেই কেটে গেল পাঁচটি বছর।

মেয়েটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম এতোদিনে।
হঠাৎ একদিন শপিংমলে দেখা হয়ে গেল।পুরোনো আবেগ আবারও জেগে ওঠলো মনের ভেতর।

মেয়েটি কসমেটিকস এর দোকানে কি যেন কিনছে।
আমাকে দেখে বলল,

  • ভাইয়া, কেমন আছেন?
    অনেকদিন পর আপনার সাথে দেখা হলো।

আমি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,

  • ভালো আছি।
    আপনি একা কেন শপিংমলে?
    আপনার বয়ফ্রেন্ড ছিল যে সে কোথায়?

মেয়েটি মাথা নিচু করে বলল,

  • সে তো এখন আর আমার বয়ফ্রেন্ড নেই ভাইয়া।

কথাটা শুনে মনের মধ্যে কেমন যেন ভালো লাগা শুরু হয়ে গেল।
মেয়েটিকে বললাম,

  • তাহলে দিনকাল কাটছে কেমন?
  • খুব ভালোই কাটছে ভাইয়া।

আমরা কথা বলার সময় হঠাৎ তিন বছরের একটা বাচ্চা ছেলে মেয়েটির কাছে এসে বলল,

  • আমাকে একটা খেলনা কিনে দিতে হবে আম্মু।

মেয়েটি বলল,

  • একটু দাঁড়াও বাবা, কিনে দিচ্ছি তোমাকে।

আমি তখন মেয়েটিকে বললাম,

  • ছেলেটি আপনাকে আম্মু ডাকছে কেন?
  • সে আমার ছেলে, আম্মুই তো ডাকবে ভাইয়া।

এরমধ্যে আবার একটা ছেলে এসে বলল,

  • এই তোমার কেনাকাটা সব শেষ হয়েছে?
    আর কতক্ষণ লাগবে?

আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলাম এটাই তো সেই ছেলে যার সাথে এই মেয়ের ছবি তুলে দিয়েছিলাম।

আমি তখন মেয়েটিকে বললাম,

  • আপনি তো একটু আগে বললেন সে এখন আর আপনার বয়ফ্রেন্ড লাগে না।
  • ঠিকই তো বলেছি ভাইয়া।সে তো এখন আমার আর বয়ফ্রেন্ড না, সে এখন আমার স্বামী।

কথাটা শুনে বুকটা কেমন যেন চিনচিন করতে লাগলো।

আজ আমার মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য
কোনো গীতিকার গান রচনা করেনি কিংবা কোনো সাহিত্যিক সাহিত্য রচনা করেনি।

আজকেও বুক ভরা কষ্ট নিয়ে তাদের বললাম,

  • আপনার জন্য শুভকামনা রইলো।

বাসায় এসে আজকেও মনমরা হয়ে বসে আছি।

আম্মাকে গিয়ে বললাম,

  • আম্মা, পাঁচ বছর আগে যেই মেয়ের সাথে পার্কে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল আজকে আবার তাকে দেখেছি।মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে আম্মা।

আম্মা অনেক আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

  • ঐ ছেলেটার সাথেই কি বিয়ে হয়েছে?

আমি কোনো কথা না বলে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালাম।

আমার মাথা নাড়ানো দেখে আম্মা হাসিমুখে বলল,

  • যাক শুনে খুশী হলাম যে ওদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে।দুনিয়ার সব ভালোবাসা যদি এভাবে পূর্ণতা পেত তাহলে দুঃখ-কষ্ট শব্দটার প্রচলন অনেকটা কমে যেত।

আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে বললাম,

  • তোমার ছেলের কথাটা ভাবলে না একবার।
    অবশ্য তোমার কথাই ঠিক ছিল আম্মা।আমি আকাশকুসুম কল্পনা করে ফেলেছিলাম।

আমার মাথায় হাত দিয়ে আম্মা বলল,
“এখন বুঝলি তো দুনিয়ায় কেউ কারো দুঃখ চিরদিনের জন্য জমা রাখে না।শেষমেশ নিজের দুঃখ নিজেকে নিয়েই চলতে হয়।”

একটু ভেবেচিন্তে দেখলাম,

  • আম্মার কথাটাই ঠিক।দুনিয়ায় কেউ কারো দুঃখ-কষ্ট জমা রাখে না।তবুও আমরা অন্যের কথা চিন্তা করে নিজের মন খারাপ করে বসে থাকি।

রুম থেকে চলে যাওয়ার সময় আম্মা বলল,

  • আমার কথা মতো চললে আজকে তোকে এই পরিস্থিতির স্বীকার হতে হতো না।
  • কালকে থেকে তোমার কথামতো চলবো আম্মা।
  • আজকে সমস্যা কি?
  • আজ শেষবারের মতো মন খারাপ করে বসে থাকবো।

-গরুর মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করেছি আজকে। খেয়ে যা তাহলে।

  • বিরিয়ানি আমার মুখ দিয়ে পাকস্থলী পর্যন্ত নামবে না, আম্মা।

আজকে আমি কিছুই খাবো না।আজ আমি উপোস।

(সমাপ্ত)

আক্ষেপ

লেখায়ঃ- Khadamul Alam Mithun

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
0
0
0
0
0
0
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!