মশারি বিভ্রাট

আব্বার ‘হ্যাঁ’ তে ‘না’ বলার সাহস আমরা দুই ভাইয়ের কোনো কালই ছিল না। কিন্তু সেইবার হলো। অফিস থেকে ফিরে সবেমাত্র গোসল সেরে রুমে ঢুকলাম। আব্বা হঠাৎ করে রুমে এসে আমার খাটে একটা ছবি রেখে বলল,” সাগর, তোর বিয়ে ঠিক করেছি। আমি নিশ্চিত মেয়ে না দেখেও পছন্দ করার মতো। আগামী সপ্তাহেই তোর বিয়ে।”
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম,’ আগামী সপ্তাহে কেন?” বাবা বললেন,” তুই চাইলেই এই সপ্তাহেও হতে পারে।”
আমি গলার স্বরটা আরো বড় করে বললাম,” আগামী সপ্তাহে কেন? আমি আগামী মাস, আগামী বছর, কিংবা আগামী জীবনেও বিয়ে করব না।” বিয়ের কথা নিয়ে দ্বিতীয়বার আমার কাছে আসবে না।”

বাবা আমার কথা রেখেছেন। দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা বলতে আর আসেনি আমার কাছে। তবে বাধ্য হয়ে আমাকেই যেতে হয়েছে বিয়ের দিন তারিখ জেনে নিতে। ‘না’ বলার পর থেকে বাবা অনশন শুরু করে দিয়েছিল। তাই উপায় ছিল না। বিয়ে না করে বাঁচার।

রাসেল ভাই চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন,” বিয়ে করতে তোর সমস্যাটা কী ভাই?”
আমি ক্ষীণ কন্ঠে বললাম,’ ভয় ভাই, ভয়! পুরোটা শুনুন। তারপর বুঝবেন।”

আমার বিয়ে করার আজন্ম স্বপ্নটা টগর ভাইয়ার বাসর রাতেই ভেঙে গেল!
রাসেল ভাই কিছুটা কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলেন” তোর ভাইয়ার বাসর রাতে ভাঙলে তার স্বপ্ন ভাঙবে। তোর ভাঙলো কেন?”

আমি গলাটা পরিস্কার করে বললাম,
”রাসেল ভাই প্রথম থেকে বলি। আমরা দুই ভাই ছোট থেকে দেখে আসছি শোয়ার আগে আব্বা, আম্মার রুমের মশারিটা আব্বায় টাঙায়। এখনও তাই। অনেক আগে একবার আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,’ প্রত্যেক রাতেই আপনি মশারি টাঙান। আম্মা টাঙায় না কেন? আপনার বিরক্ত লাগে না?”
আব্বা স্মিত হেসে বললেন, ” আব্বাজান, নারী জাতি বাঘ দেখে যতটুক লাফায় না ততটুক লাফায় তেলাপোকা দেখে। তেমনি সব কাজই করতে পারলেও, রাজ্যের বিরক্তি প্রকাশ করবে এই চার দিকে চার ফিতা বেঁধে দিয়ে মশারি টাঙানোটাকে। প্রথম প্রথম টাঙাতাম না। কিন্তু মাঝরাতে দেখতাম মশা আমারে খায়, তোর আম্মার কাছেও যায় না।”
আব্বার এহেন অবস্থা দেখে আমরা দুই ভাই প্রতিজ্ঞা করলাম যে বউয়ের জন্য আর যা-ই করি না কেন অন্তত মশারি টাঙানোর মতো এই বিরক্তিকর কাজটা করব না।

প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিলেন বউকে বশ করতে হবে প্রথম রাতেই। সেই অনুযায়ী কাজ করবেন ভেবে বাড়ির কুচকুচে কালো বিড়ালটা সাথে নিয়েই বাসর ঘরে প্রবেশ করলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে ভাইয়া নতুন বউকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” দ্যাখো সুমু, বিড়াল সবসময়ই আমার কাছে পছন্দের প্রাণী। তাই প্রচলিত নিয়ম মানতে আমি বাসর রাতে বিড়াল মারব না।”
ভাইয়ার আর আমার রুম পাশাপাশি হওয়ায় সবকিছু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। মনে মনে ভাইয়াকে সাবাস দিতে যাব এমন সময় ভাবীর তেজস্বী কণ্ঠ শুনতে পেলাম,”ইদুর কখনও বিড়াল মারতে পারে না। ছট করে মশারী টাঙিয়ে শুইতে আসো।”
সেই রাতে ভাইয়ার আর কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না।

রাসেল ভাই আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,” তোর বর্তমান অবস্থা কি ভাই?”

“ভালো না ভাই। তাই তো আপনার কাছে ছুটে আসা। ক্যাম্পাসের বড় ভাই আপনি। ক্যাম্পাসে থাকাকালীন ছোট বড় সব সমস্যায় আপনি সমাধান করে দিয়েছেন। এইবারও আমাকে আপনিই বাঁচাতে পারবেন।”
রোজ রাতে ভাইয়া আর আব্বার মশারি টাঙানো দেখে ভেতর ভেতর জেদ চাপলো বাড়িতে আমি ছাড়া আর কোনো আসল পুরুষ নেই সেটার প্রমাণ করেই দেখাব। এই ব্যাপারে ভাইয়ার সাথে কথা বলতে গেলেই ভাইয়া কথার প্রসঙ্গ পাল্টায়। ভাবী মুখ টিপে টিপে হাসে।

গেল সপ্তাহে বিয়ে করলাম। ভেবেছিলাম প্রথম রাতেই বউকে আমার আজ্ঞাবহ দাস করে পেলব। কিন্তু হলো তার উল্টোটা।
ভেবেছিলাম ভাইয়া যেহেতু ভাবীকে বুঝিয়ে বশ করতে পারেনি সেহেতু আমিও পারব না। বউকে পানি করতে নিজেকে আগুন হতে হবে। রুমে ঢুকা মাত্রই বউকে ঝাড়ি দিয়ে বললাল,” আমি যেহেতু রাজা না, সেহেতু তুমিও রাণী হতে পারবে না। তাই আমাদের প্রত্যেকটা কাজের জন্য আলাদা আলাদা কাজের লোক থাকবে না। রুমের যাবতীয় কাজ তুমিই করবে। প্রতি রাতে আমি রুমে ঢুকার আগে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়বে। দ্বিতীয়বার যাতে বলতে না হয়।”

কাজ হয়েছে এই ভেবে নিজেকে নিয়ে নিজে গর্ববোধ করছি ঠিক সেই মুহূর্তে বউ আমাকে দ্বিগুণ ঝাড়ি দিয়ে বলল,” তোমার এই মেজাজ নিয়ে আর যা-ই করো, আমার সাথে সংসার করতে এসো না। কাবিননামায় বিশ লক্ষ টাকা লেখা আছে। এক টাকাও বুঝিয়ে দাওনায় তবুও লেখা আছে পাঁচ লক্ষ টাকা উসুল। তাই সেগুলো বাদ দিলেও আরও পনেরো লক্ষ টাকা পাই। সেগুলা যদি দিয়ে দিতে পার বলো, কালকেই চলে যাই।”

পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যাচ্ছে ভেবে একটু শান্ত গলায় বললাম, ” বউ, আচ্ছা তুমি জানো মশারীর চার পাশে চারটা ফিতা কেন?”
বউ অভিমানের সুরে বলল,” একটা রুমের চারটা দেওয়াল তাই।”
“উহু, ভুল জানো। চারটা ফিতার কারণ হচ্ছে স্বামী স্ত্রী দুইজনেই দুই পাশের দুই ফিতা দুই দেওয়ালে টাঙাবে। চাইলে তো তিন কিংবা পাঁচ ফিতা হতে পার তো। হয়নি। কারণ স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া হবে তাই।”
বউ কিছু সময় আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,” এই যে প্রতিটা রুমে চারটা করে দেওয়াল, সেই দেওয়াল তৈরীর সময় কখনও আমাদের নারী জাতির কেউ এসে কি বলছে যে,” দু’টো দেওয়াল পুরুষ মিস্ত্রি বানাবে,দুটো আমরা! বলেছে?”
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।
বাধ্য হয়ে প্রতি রাতে শোয়ার আগে আব্বা আর ভাইয়ার মতো মশারিটা আমিই টাঙাচ্ছি। কিন্তু এইভাবে আর কত! আপনিই এর একটা সমাধান খুঁজে বের করুন রাসেল ভাই। আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না আমাকে রক্ষা করতে।

রাসেল ভাই নিজের আসনে একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বললেন,” শুধু রাতেই মশারি টাঙাস? সকালে ঘুম থেকে উঠে তুলতে হয় না?”
“না ভাই তুলতে হয় না।”
“সত্যিই তুলতে হয় না?”
“হ্যাঁ ভাই সত্যিই।”
কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় ভেতর রুম থেকে ভাইয়ের ডাক আসে। বউ ডাকছে। আমি চুপচাপ ড্রয়িং রুমে বসে আছি। ভেতর রুম থেকে যে কটা শব্দ কানে আসলো তাহার সারমর্ম হলো এই যে, ” দামড়া বেডা, প্রতিদিন মনে করিয়ে দিতে হয় কেন বিছানা থেকে নামার আগে মশারি তোলার কথা?”
একটু পর রাসেল ভাই এসে আমার পিঠ চাপড়ে বলল,”দামড়া বেডা বাড়াবাড়ি করিস না। ভালো হবে না। আমিও প্রথমে বাড়াবাড়ি করছিলাম। ফলাফল রাতে মশারি টাঙানোর সাথে সকালে মশারি উঠানো ফ্রী! “

– Zinnat Rima

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
1
4
0
0
0
2
Zinnat Rima
Written by
Zinnat Rima
3 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!